বন্ধ দরজায় কড়া নেড়ে গেল রেহানা মরিয়ম নূর
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী ।। রেহানা মরিয়ম নূর চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, অনেকদিন পর দেশের একটি চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা – সমালোচনায় মুখর হচ্ছি আমরা। এর মূল কারণ হিসেবে বলা যায়, যারা ছবিটি দেখেছেন, প্রায় প্রত্যেক নারী রেহানার ভেতরে কোথাও না কোথাও নিজের ছায়া খুঁজে পেয়েছেন। সিনেমার পর্দায় রেহানার সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়গুলো আমাদের প্রত্যেকের বড্ড চেনা।
কাহিনীর ঘনঘটা নেই, তত্ত্বকথার বাহুল্য নেই। খুব অল্প কথায় গল্পটা এগিয়ে নেয়া হয়েছে। একজন একাকী নারী ও একক অভিভাবকের ভূমিকায় রেহানা বৈরী সমাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে প্রতিনিয়ত।
কর্মজীবী মা মাত্র জানেন, রোজ সকালে অফিসে পৌঁছানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁদেরকে কয়টা ধাপে যুদ্ধ করতে হয়। বিশেষ করে যাদের বাড়িতে শিশু সন্তান বা পরিবারের বয়োবৃদ্ধ সদস্য থাকে, তাদের কর্মক্ষেত্রে আসার প্রস্তুতি নিতে হয় এদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা, স্কুলে আনা-নেওয়া, টিফিন, খাবারদাবার, ওষুধপত্র – সবকিছু নিশ্চিত করে। সেই সাথে গৃহকর্মে সহায়তাকারীদের যখন তখন কাজে অনুপস্থিত থাকা, বিনা নোটিশে কাজ ছেড়ে দেবার জন্য সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয় পরিবারের নারী সদস্যকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষ সদস্যরা তৈরি চা – নাশতা খেয়ে, তৈরি লাঞ্চবক্স নিয়ে অফিসে রওনা দিয়ে থাকেন। বাচ্চা স্কুলে দেবার দায়িত্বও যদি পালন করেন, সেই ইউনিফর্ম পরা তৈরি বাচ্চারও জুতো – মোজা – পোশাক ঠিক রাখা, টিফিন – পানি, ব্যাগ সবকিছু মাকেই আগেভাগে ঠিকঠাক করে রাখতে হয়। এরপর যারা গণপরিবহনে যাতায়াত করে থাকেন, তাদের নিত্যকার লড়াই হলো যাত্রাপথে যৌন হয়রানির কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করা। অফিসের পরিবেশও সবার ক্ষেত্রে অনুকূলে থাকে না। ঘরে – বাইরে নারীকে দশভুজা ভাবতে আরামবোধ করি আমরা। অন্যদিকে সংসারে থিতু হয়ে উঠতে, বাবা হয়ে উঠতে, সহযাত্রী হয়ে উঠতে পুরুষের উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা ও দায়িত্বহীনতাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয় সমাজ। আমরা প্রশ্ন করি না, কেন নারীকে দশভুজা হয়ে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ জানতে হবে? কেন পুরুষের জন্য জীবন জুড়ে এতো আদিখ্যেতা বরাদ্দ?
রেহানা মরিয়ম নূর প্রসঙ্গে ফিরে আসি। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে রেহানা একজন একলা মা। রেহানার মতো সঙ্গী হারানো, কি সঙ্গীর সাথে বিচ্ছেদ হওয়া একলা মায়ের প্রতিদিনের সংগ্রাম থেকে যে ক্ষোভের জন্ম, আমরা আসলে তার গভীরে খুব একটা চিন্তা করি না যতোটা করি তার ব্যক্তিগত জীবন আর চরিত্র নিয়ে রসিয়ে আলাপ জমাতে। রেহানার তবু কপাল ভালো যে, সে শিক্ষিত এবং তার একটি চাকরি ছিল, সে তার বাবা – মায়ের বাড়িতে থেকে কাজে যেতে পেরেছে, একজন ভাই ছিল যে তার মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার কাজটুকু করে দেয়। কর্মক্ষেত্রে রেহানাকে প্রতি পদে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা ও আধিপত্যের সাথে লড়তে হয়। সমাজের সাথে একলা মেয়ের নিরন্তর এ লড়াই রেহানাকে কখনো দিশেহারা, ক্লান্ত করে বৈ কি! পেশাগত জীবনেও সে দারুণ সফল কেউ না। রেহানা সমাজের প্রত্যাশিত সর্বংসহা, দশভুজা নারী বা সুপার হিরো হয়ে উঠতে পারে না। তাই সে সবসময় কাঙ্ক্ষিত সংবেদনশীল আচরণ না করতে পেরে বরং মেজাজ হারায়, বিষণ্ণতায় ভোগে, কন্যা ইমুর সাথে রাগী স্বরে কথা বলে। কিন্তু স্কুল থেকে যখন অভিযোগ আসে যে ইমু তার এক ছেলে সহপাঠীকে কামড়ে দিয়েছে, তখন সে ইমুর সাথে কথা বলে কারণ জানার চেষ্টা করে। এবং তা জানার পর সে ইমুকে সমর্থন দেয়।
নীলচে, ঘোলাটে পর্দায়, আলো-বাতাসহীন অফিসকক্ষে রেহানার শ্বাসরুদ্ধ দিনরাত্রি দেখে মনে হয় যেন “একলা গহন পথে চলতে জীবন সহসা বিক্ষুব্ধ”।
রেহানার পুরুষ সহকর্মী, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, মেয়ের স্কুলের শিক্ষক – এরা প্রত্যেকেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধ্বজা উড়িয়েছে শুরু থেকে শেষ অব্দি। মেনে নেয়া বা মানিয়ে চলার চিরায়ত যাতাকলে পিষ্ট হয়ে স্বকীয়তা হারাতে দেখি শিক্ষক দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার মেডিকেলের ছাত্রী অ্যানি এবং সেই শিক্ষকরূপী ধর্ষকের স্ত্রী চরিত্রকে। প্রতিটি চরিত্রকে চেনা যায়, স্পর্শ করা যায়। সবার মাঝে কেন্দ্রীয় চরিত্র রেহানা মরিয়ম নূর ব্যতিক্রম। কারণ যাপিত জীবনের বহুমাত্রিক টানাপোড়েন এবং শ্বাসাঘাত তাকে পরাস্ত করতে পারে না। রেহানা অন্যায় দেখলে প্রতিবাদী হয়। পুরুষ সহকর্মীর ছাত্রীকে শারীরিকভাবে হেনস্থা করার অপরাধকে সে কিছুতেই ছাড় দিতে রাজি হয় না কারণ একবার পার পেয়ে গেলে আবারো অন্য কোনো মেয়ে তার অনৈতিক আচরণের শিকার হবে। সহপাঠীর কাছে ক্ষমা না চাইলে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ইমুকে অংশ নিতে দেয়া হবে না – স্কুল কর্তৃপক্ষের এই অন্যায্য শর্তের কাছে মেয়েকে মাথা নত করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রেহানা।
শেষ দৃশ্যের কাছাকাছি এসে এই জায়গাতে আমার মনে হয়েছে, রেহানার সিদ্ধান্তটি সঠিক তবে এখানে সে ইমুর সাথে সরাসরি কথা বলতে পারতো, ব্যাখ্যা দিতে পারতো কেন সে অন্যায়ভাবে ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে অনুষ্ঠানে অংশ না নেয়াটাকে যুক্তিযুক্ত মনে করেছে। রেহানার কাছ থেকে শুদ্ধ আচরণের আশায় নয়, ইমুর কাছে সত্যটা পৌঁছানো দরকার ছিল। সন্তানের সাথে এমন বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে রেহানার প্রতিবাদের মশালটা আগে থেকেই লড়াইয়ে শামিল ইমুর হাতে তুলে দেয়া যেত। আরেকটি বিষয়ে আমার প্রশ্ন রয়ে গেছে তা হলো পাকিস্তানি কায়দায় রেহানার ওড়না ব্যবহার করা। যেহেতু রেহানার মধ্যে সমাজের চোখে তথাকথিত “ভালো মেয়ে” সাজার চেষ্টা ছিল না, সেহেতু পর্দার পরাধীনতায় রেহানাকে না দেখালেই ভালো হতো। বিদেশি দর্শকেরা এই ছবি দেখে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মেয়েদের মাঝে তফাৎ খুঁজে পাবে না, এই আক্ষেপ রয়ে গেল। মৌলবাদকে প্রতিহত করার যুদ্ধটা কিন্তু আমাদের ফুরিয়ে যায়নি। সেই কারণে হলেও এটা নিয়ে ভাবা যেত।
দর্শক হিসেবে শেষ পর্যন্ত রেহানার জয় – পরাজয় আমাকে ভাবায় না। বরং লড়াইটা জারি রাখার জন্য বারংবার যে আত্মশক্তি অর্জন, তাকে আমি কুর্ণিশ করি।
রেহানা মরিয়ম নূর কড়া নাড়তে পেরেছে। বন্ধ দরজাটা খুলে যাবে একদিন নিশ্চয়ই!