মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং তসলিমা নাসরিন
মাসকাওয়াথ আহসান ।। ফেসবুকে কিছুদিন পর পর যে এ যুগের জোয়ান অফ আর্ককে দেখতে পাই আমরা; চিন্তার জগতে পিছিয়ে থাকা মধ্যযুগের মানুষের ঘৃণার আগুনে পুড়তে; যে ডাইনি শিকারের লালসার লালামাখা লোভ আমরা দেখি আন্ডার কনফিডেন্ট কতিপয় পুরুষের মাঝে; তা এতোই আপত্তিজনক যে একবিংশ শতকে বসে এই আদিম সক্রিয়তা বরদাশত করা অসম্ভব।
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা মেধাবী ডাক্তার তসলিমা নাসরিন; ‘তোমাকে ডাক্তার হতে হবে’ বলা সমাজে নিজের ইচ্ছার বিপক্ষেই ডাক্তারিবিদ্যা পড়েছেন। নইলে হয়তো এই সাহিত্যমনস্ক মানুষটি সাহিত্য কিংবা লিবারেল আর্টসের পছন্দের কোন শাখায় পড়তেন। তবু সাহিত্যের নেশায় ছুটে বেড়িয়েছেন। বড় কবিদের সঙ্গে মিশেছেন কবিতার টেকনিক্যাল বিষয় পরিষ্কার করতে; ছন্দ-মাত্রা-ওজন বুঝে কবিতাকে পারফেকশনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যুগে যুগে কবিরা সিনিয়র কবিদের শরণাপন্ন হয়েছেন। বাংলাদেশ রেনেসাঁর কালে সোনালী যুগের কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে মিশেছেন। সেরা কবি, সেরা সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রেম হয়েছে, বিরহ এসেছে; তবু ঐ যে সাহিত্য রচনার লক্ষ্য, তা থেকে দূরে সরে যাননি।
ঐ সময়টিতে সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেসের সাফল্য অনেক তরুণ সাহিত্যিককে আকৃষ্ট করেছিল, প্রচলিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করার প্রতি। আমাকেই অনেক বন্ধু বুদ্ধি দিতো, এতো কষ্ট না কইরা একটা বিতর্কিত বই লিখে ফেল; নিষিদ্ধ না হইলে বিখ্যাত হয় নাকি লেখক। এরকম প্রভোকেশান তসলিমা নাসরিন আপাদের বন্ধুবৃত্তেও প্রচলিত থাকাই স্বাভাবিক। আর বিতর্কিত বই লেখার চল্ তো ইউরোপে ভুরি ভুরি। সভ্যতা এতো এগিয়েছে যে ঐখানে অনুভূতিতে আঘাত হানা কঠিন। বাংলাদেশের মতো ছ্যাঁত করে অনুভূতিতে আঘাত লাগার মতো বিজন গ্রাম আর কটিই বা অবশিষ্ট আছে!
নাসরিনের কবিতা লেখার সময়টা ভালো যাচ্ছিলো। আমাদেরও ভালো লাগতো একুশে বইমেলায় তাকে স্টলে বসে অটোগ্রাফ দিতে দেখে। সে সময়টা খুব সহজাত ছিল ঢাকার পরিবেশ। ফলে বইমেলায় যারা থাকতো তাদের একটা ফেলো ফিলিং তৈরি হয়ে যেত। সে কারণে যেদিন ওনার উপন্যাস ‘লজ্জা’-কে পুড়তে দেখেছিলাম; যেদিন পুলিশকে দেখলাম ওনাকে সিকিউরিটি দিয়ে নিয়ে যেতে; সেদিন অনেক কষ্ট হয়েছিলো। বুঝেছিলাম দাউদ হায়দারের নিয়তি বরণ করতে যাচ্ছেন তিনি; সাহিত্য নিষিদ্ধ হবার কষ্ট এখন সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
সেই যে স্বজন ছাড়লেন তিনি; আর দেখা হলো না তাদের সঙ্গে। ময়মনসিংহের সেই বাড়িটিতে আর কন্যার প্রবেশাধিকার নেই। বায়তুল মোকারকম মসজিদের সামনে মিছিল করে রাষ্ট্রের লালসালু ইমিগ্রেশন অফিসার তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করে দিলো।
এ আর কিছুই না; দক্ষিণ আফ্রিকার মতো সাদা মানুষেরা এদেশে কালো মানুষের ওপর দীর্ঘকাল অত্যাচার ও উচ্ছেদ করেছে; তাই কালো মানুষেরা জামায়াত-বিএনপি-আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে আজন্ম লালিত প্রতিশোধ স্পৃহা লালন করছে। তারা সাদাদের প্রিভিলেজড ছেলে-মেয়েদের উচ্ছেদ করে কালোদের দেশ গড়তে চায়। এই দেশে তো কোন নেলসন ম্যান্ডেলা নেই যে কালোদের এই রিভার্স এপারথেড বন্ধ করে বললেন, কালো আর ধলো বাহিরে কেবল; ভেতরে তার একই লাল রক্ত প্রবাহ। এখানে সাদা কালো প্রচলিত অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। নাসরিন-দাউদ হায়দার এরা প্রিভিলেজড শ্রেণির ছেলেমেয়ে। এরা বুদ্ধি বিকাশের পরিবেশ পেয়েছে জন্যই ধর্মীয় কুসংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যেমন প্রিভিলেজড শ্রেণির অগ্রসর চিন্তার মানুষ ছিলেন। প্যারিসে বসবাস ও মৃত্যুবরণ করায়, নিজ গ্রামের মজিদদের ধাওয়া খেতে হয়নি তাকে।
বাকস্বাধীনতা বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার হিসেবে চিহ্নিত। ধর্মের সমালোচনা বা রাজনৈতিক দলীয় নেতার সমালোচনার জন্য সভ্য কোনো দেশে বই বা লেখক আর নিষিদ্ধ হননা। শুধু এই মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা চালু আছে বাংলাদেশের মতো চিন্তায় খর্ব; শৈশবে পুষ্টি না পাওয়ায় মস্তিষ্ক বর্ধিত না হওয়া মানুষে কিলবিল করা জনপদে, এমনটা পৃথিবীতে আর খুব বেশি নেই।
করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে পাকিস্তানে মোল্লারা ফেসবুক লাইভ করে বলতো, এই ভ্যাকসিনের মধ্যে চিপ বসানো আছে, ইহুদি নাসারারা মনিটর করবে সবাইকে; তাই টিকা দেবেন না। খুব সম্ভবত ডান্ডা খেয়ে একদিন পরেই তারা একই ফেসবুক লাইভে বললো, ভ্যাকসিন নিন, দোয়াও লাগে; দাওয়াও লাগে। বাংলাদেশে এইসব ডান্ডা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে খুব দেয়া হয়। ক্ষমতায় থাকার জন্য ডান্ডার ব্যবহার প্রসিদ্ধ, কিন্তু দাউদ হায়দার বা তসলিমা নাসরিনকে মব ভায়োলেন্স বা পাবলিক লিঞ্চিং থেকে বাঁচানোর মতো শক্ত ডান্ডা জাতির জনকের হাতেও ছিল না; বিএনপির সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার হাতে ছিল না। ক্ষমতায় থাকার জন্য এইসব আপোষ আজ পাকিস্তানের চেয়ে বেশি কট্টর মুসলমান বাংলাদেশে সৃজন করেছে।
নাসরিন আপা ভারতেও আক্রান্ত হয়েছেন কট্টর ইসলামপন্থীদের হাতে। সেখানে বসবাসের জন্য কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের সাহায্য নিতে হয়েছে তাকে। এ এমন এক হিংস্র জঙ্গল যেখানে কট্টরপন্থার ভক্তদের বিরোধিতায় আরেকটি চরমপন্থী দলের সাহায্য না নিয়ে টিকে থাকা মুশকিল। আবার ভিসা বাড়ানোর ভেরিফিকেশনে আসে পুষ্টি না পাওয়ার ফলে মস্তিষ্ক বর্ধিত না হওয়া কালো সাব ইন্সপেক্টর; সে তার বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে কী করে বুঝবে যে কবি বা সাহিত্যিক কখনোই রাষ্ট্রের জন্য ঝুঁকি নয়, রাষ্ট্রের ঝুঁকি বাড়ে কেবল নিম্ন বুদ্ধাংকের সাব ইন্সপেক্টরের ওসি প্রদীপ হয়ে ওঠাতে। তখন রাষ্ট্র বলে, আমাকে একটি ওসি প্রদীপ দাও; আমি তোমাকে ক্রসফায়ার উপহার দেবো।
নাসরিন আপার ইউরোপে থাকার সুযোগ থাকলেও স্বদেশের জন্য মন কাঁদে। তাই স্বদেশের সঙ্গে জলহাওয়ার মিল আছে, ভারত থেকে ময়মনসিংহের আকাশটা কাছে; তাই ভারতে বসবাস করতে চান। আজকের কট্টর হিন্দুভারতে থাকার জন্য তিনি মোদিদাদুর প্রশংসা করেন।
তসলিমা নাসরিনের অটোবায়োগ্রাফি দুই বাংলার শিল্প-সাহিত্যের জগতকে বিক্ষুব্ধ করেছে। নাসরীন আপা তন্নতন্ন করে প্রেম খুঁজে দেখেছেন, পুরুষ সমাজটি ললিতলোভনকান্তি মাংসের লোভে লোলুপ শেয়াল হয়ে ঘুরছে। উনি সেইসব শেয়ালের গপ্পো করায় তারা রেগে গেছেন।
নির্বাসিত জীবন থেকে দেশে ফিরতে চেয়ে যখন একজন কথিত বন্ধুরও গরজ খুঁজে পাননা তিনি; তখন তো তাঁর মনে হবেই এটা বন্ধুত্ব ছিল না; এ ছিল শঠতা-শিল্পের ছলনা দিয়ে হরিণী শিকারের নখরা।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আঠারো বছর পেরোনোর পর প্রতিটি সম্পর্কই মিউচুয়াল কনসেন্টে হয়। সেই গোপনীয়তা ভঙ্গ করা আধুনিকতা নয়; এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ‘কইয়া দিমু’ টাইপের ব্যাপারটা খুবই আপত্তিজনক। এই জায়গায় আমি নাসরিন আপার সমালোচনাই করবো।
কিন্তু সেই সমালোচনার অধিকার আমার নেই, কারণ আমিও নাগরিক সমাজের সদস্য হিসেবে নাসরিন আপার উচ্ছেদ ঠেকাতে পারিনি। শুধু পেলব চু চু করেছি; তারপর ভুলে গেছি সেই মানুষটিকে; যিনি অফ হোয়াইট শাড়ী পড়ে ফোল্ডিং চেয়ারে বসে বই পড়তেন বর্ধমান হাউজের লনে। চেনা নন তবু পরিচিতের হাসি হাসতেন সভ্যতার নিয়মে।
তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাসের জন্য বাংলাদেশের ভাবমূ্র্তির কোনো ক্ষতি হতে দেখিনি। বরং তাকে উচ্ছেদ করার দায়টি বিশ্বব্যাপী নিন্দিত। লজ্জা উপন্যাসের চেয়েও যে বড় লজ্জা শুধু অভিমত প্রকাশের দায়ে নাসরিনের নির্বাসনদণ্ড, সেই অপরাধবোধ কখনো খালেদা-হাসিনার মাঝে দেখিনি।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]