একদিন স্যারের নোংরা হাতটা মুচড়ে দেবে দুর্গা?
অপর্ণা হাওলাদার ।। নারী বিসিএস অফিসারেরা “স্যার” হয়ে উঠতে চাইছেন; আপা বা ম্যাডাম থাকতে চাইছেন না। অন্যদিকে, আমাদের প্রচন্ড পুরুষতান্ত্রিক সমাজও আমলাতন্ত্রে নারীর চোখরাঙ্গানি মানছে না। এই বিবাদ আমার প্রফেশনাল গবেষক চোখে অবশ্য অবাক ঠেকছে না। একটা সমাজ হাজার বছরের “আবহমান সংস্কৃতি” থেকে বের হয়ে প্রথমবার অফিসে আদালতে এত নারী দেখছে – সমাজের পুরুষ এবং কর্মজীবী নারী সবার জন্যই সময়টা নতুন। সামাজিক কাঠামো ভাঙলে কিছু গর্জন হবেই, ভেতরে এবং বাইরে। “স্যার” সম্বোধনের বিতর্কটি তাই কিছুটা রাজনীতির, কিছুটা অর্থনীতির, কিছুটা সমাজনীতির। আমলাতন্ত্র এবং পুরুষতন্ত্র দুই ভিলেনের মারামারি-কেচ্ছাকাহিনি বাদ দিয়ে আমি বরং আমার দেখা ও জানা কিছু স্যারের গল্প বলি।
আমি ক্লাস থ্রি পর্যন্ত বরিশালে পড়তাম। বরিশালে স্কুলে পুরুষ শিক্ষক ছিলেন এমন মনে পড়ে না। নারী শিক্ষকদের বরিশালে আপা/দিদি বলারই চল ছিল। বরিশাল সদর গার্লসে আমার দিদিমা শিক্ষার্থী ছিলেন চল্লিশের দশকে, মা শিক্ষার্থী ছিলেন সত্তরের দশকে, আমি ১৯৯০ এ। প্রজন্মান্তরে এক স্কুলে গেলে যা হয়, মা মোটামুটি “দিদি, মাংসটা আপনার – হাড্ডি ফেরত দিলেই হবে” মুডে মেয়ে স্কুলে ছেড়ে দিয়ে এসেছিল। মফস্বলের মেয়েদের স্কুলে নব্বইয়ের দশকে কনজার্ভেটিভ আবহাওয়া তো ছিলই, কিন্তু মফস্বলজনিত সরলতাও ছিল। শিক্ষকেরা নিজের সন্তানের মতোই আদর করতেন, প্রয়োজন বোধ করলে শাসনও করতেন। সম্বোধন নিয়ে বিবাদে ঢোকার কারণ ছিল না।
“স্যার” শব্দটা যে এমন কোনো মহত্ত্বে আটকানো না, তা জানলাম ক্লাস ফোরে ঢাকায় উদয়ন স্কুলে আসার পর। পুরুষ শিক্ষক সংখ্যায় কম ছিলেন। নারী শিক্ষকদের আমরা “টিচার” ডাকতাম। “মিস” বা “ম্যাডাম” শব্দের প্রচলন ছিল না। উদয়ন স্কুলে যেমন অনেক পুরুষ শিক্ষক ছিলেন যাদের অংক, ইংরেজি পড়ানোর স্টাইল আজও মনে পড়ে। তবে কথা হচ্ছে অন্য এক ধরণের “স্যার”দের নিয়ে, সামাজিক চাপে তাদের “স্যার” ডাকতে হতো।
ক্লাস সিক্সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইআর বিভাগ থেকে তরুণ শিক্ষকেরা পড়াতে আসলেন; প্রতি বছরই আসতেন। আইআর থেকে আসা তরুণ শিক্ষকটি বেত দিয়ে মারতেন। বেত দিয়ে মারা সেইকালে তেমন অদেখা অজানা ছিল না। কিন্তু উনি বেত দিয়ে মারতেন আমাদের তখনো গড়ে ওঠেনি যে নারীশরীর, ঠিক সেই স্তন তাক করে। বারবার উনি মারতেন; ওনার মারের স্টাইল দেখলে মনে হতো উনি বেত দিয়ে কিছু একটা গভীরতা মাপছেন। সকালে ক্লাস সিক্সের কয়েকটি মেয়ে মিলে আমরা প্রধান শিক্ষিকার রুমে প্রথমবার ঢুকেছিলাম এই অভিযোগ নিয়েই – আমরা এই শিক্ষকের ক্লাস করতে চাই না। আরও মেয়েদের আমরা বলেছিলাম আমাদের সাথে আসতে, কিন্তু মেয়েরা রাজি হয় নি ভয়ে লজ্জায়। “স্যার” এর নোংরামি ঢাকার বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে লজ্জায়, সংকোচে আমরা বড় হয়ে উঠেছি। ওই বয়সের ছেলেদের কিন্তু সমাজ “শিশু” “ছোট মানুষ” ডাকে। নারী শরীরের কারণে “শৈশব” আমাদের কোনোদিন ছিল না।
মনে পড়ে আরও স্যারদের কথা। স্যার ছিলেন একজন যিনি নিজের নামের অর্থ বারবার বলতেন “আমার নামের অর্থই হলো কিশোরীকে আমি মোহিত করে রাখি”। মেয়েদের উনি ক্রমাগত জ্বালিয়ে যেতেন। ক্লাস এইটে মেয়েদের ক্লাসরুমে ঢুকে ইঙ্গিতপূর্ণ কৌতুক করতেন। সেই ইঙ্গিত বোঝার বয়স না হলেও অস্বস্তি লাগার ইন্টিউশন আমাদের ছিল। সহপাঠী ছেলেরা আজও ওনাকে নিয়ে মজা করে। বৃদ্ধ পুরুষের নারীপ্রিয়তাকে আমাদের সমাজে “মজা” হিসেবে দেখা হয় কেন? সেই নারী শিশুর শরীরে থাকলেও, সে নারীই। পুরুষের যাবতীয় কদর্য চাহিদা, অভব্যতার ভার তাকে নিতেই হয়।
ক্লাস টেনে বাসায় এক শিক্ষক রাখা হলো – মাঝবয়সী এক লোক। অংক ভালো পড়াতেন। এই ভালো অংক পড়িয়েই হঠাৎ গায়ে হাত দিলেন একদিন। মামা ডাকতাম তাকে আমি। মামাসুলভ হাতখানা অপমানে ভুলে যেতে যেতে উনি নিয়ে আসলেন কুৎসিত পত্রিকা। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সেখানে নোংরা কথা লেখা, উনি আমাকে পড়ে পড়ে শোনালেন। বাসায় তুমুল গণ্ডগোল করে সেই শিক্ষক আমি তাড়িয়েছিলাম, কিন্তু আমার শরীর থেকে ওনার হাতের দাগ যায় না কেন? আজ এই পূর্ণবয়সের তথাকথিত স্বাধীন জীবনেও শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আমার সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে কেন ওই দৃশ্য চোখে আসলে?
ভিকারুন্নিসা কলেজেও আমাদের পুরুষ শিক্ষক তেমন ছিলেন না। পুরুষ শিক্ষকেরা কী/কত প্রকার সেটা জানা মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে।
অনেকে কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে। আজকের বিশ্বে কেবল অনার্স বা মাস্টার্স এর রেজাল্ট দেখে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ ভাবাই যায় না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি বিশ্ববিবেচনায় নতুন। যে হারে ১৯৪৭ এর পরে মাইগ্রেশন হয়েছে, বা যে নৃশংসভাবে ১৯৭১ এ শিক্ষক নিধন হয়েছে, তাতে প্রভাষক পদে স্নাতক পাস করার পর শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন হয়তো ছিল। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে অনার্স/মাস্টার্স পাশ ২৬/২৭ বছরের ছেলেদের লেকচারার নিয়োগ দেওয়ার ফলে লৈঙ্গিক বৈষম্য কতটা বাড়ানো হচ্ছে, তা নিয়ে কথা শুরু করা হচ্ছে না।
প্রায় আনাড়ি, স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থীকে কেবল ফলাফলের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয় বলে মনে করি। প্রফেশনাল ট্রেইনিং ছাড়া এই শিক্ষকেরা যখন নারী শিক্ষার্থীদের সামনে যান, অনেক কাজই করে বসেন যেটা বয়সজনিত বিবেচনায় বা অবিবাহিত পুরুষের “মেটিং স্ট্র্যাটেজি” মানা গেলেও, শিক্ষকদের কাছে থেকে আশা করা যায় না। এই কাজের নমুনা হচ্ছে – একগাদা নারী শিক্ষার্থীকে প্রেম প্রস্তাব দিতেই থাকা। ফার্স্ট ইয়ার থেকে শুরু করে প্রতি ব্যাচে কয়েকটি মেয়েকে একত্রে বিরক্ত করতেই থাকা। নারী শিক্ষার্থীদের পারসোনাল খবর জানার জন্য ক্রমাগত গুণ্ডামি করা, এমনকি চর লেলিয়ে দেওয়া।
প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌনতা সংক্রান্ত অভিযোগ আনা হয়। ১৯/২০ বছরের মেয়েদের এই অভিযোগ তুলতে হবে কেন? অভিযোগের মাত্রার বাইরেও থাকে “স্যার”দের বাউন্ডারি ক্রসের প্রতিদিনের ঘটনা। যেমন আমাদের এক “স্যার” আমাকে বলেছিলেন আমি দেশের বাইরে পড়তে যেতে চাই পুরুষের প্রতি আগ্রহের জন্য। বাবা মা থেকে দূরে থাকলে আমার সুবিধা, তাই। এই একই “স্যার” আমার এক সহপাঠীকে অনার্সে থাকতে বলেছিলেন “তোমার বাচ্চা হয় না কেন এখনো?”। মেয়েটির খুব অল্পবয়সে বিয়ে হয়েছিল।
শেষ করছি কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া কাহিনী দিয়ে। আমি তখন পিএইচডি শেষে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে পোস্টডক হিসেবে কর্মরত। ঢাকায় গিয়েছি ২০২০ এর ফেব্রুয়ারিতে, বইমেলায় যাওয়ার পথে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সামনে আমার এক পুরোনো “স্যার” এর সাথে এতটাই হঠাৎ দেখা যে আমার কোথাও লুকিয়ে পড়ার জায়গা ছিল না। তো, উনি আমাকে প্রশ্নবাণ ছুঁড়তে থাকলেন – এখনো সিঙ্গেল কেন? তোমার বাবা এপার্টমেন্ট কিনেছে কোথায়? কত স্কয়ার ফিট? – এগুলোকে পারসোনাল প্রশ্ন ধরলামই না, কারণ উনি এক পর্যায়ে আমার খুব কাছে ওনার শরীরটা নিয়ে আসলেন এই বলতে যে এই দশ বছরে ওনার অনেক চুল পড়ে গেছে। মাথা এত কাছে নিয়ে আসলেন যে আমাকে ছিটকে সরে যেতে হলো। “বাউন্ডারি” নিয়ে আমাদের “স্যার”রা কি ভাবেন?
অন্তত আমরা যারা বাংলাদেশে মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে স্কুল কলেজে বড় হয়েছি, আমরা জানি “স্যার” শব্দটা ক্ষমতার প্রতিফলন নিশ্চয়ই, কিন্তু শ্রদ্ধার নয়। মল্লিকা সেনগুপ্তের ‘কন্যাশ্লোক’ কবিতাটি আমাদের শৈশবের প্রতিফলন। “স্যারটা নোংরা বটেক কথাটা মানছো না?” চোখের সামনে দুর্গা হওয়ার বাসনা রেখেই আমরা নীরবে বড় হয়ে গেছি। দুর্গার মত “শেষে একদিন স্যারের নোংরা হাতটা, মুচড়ে দিয়েছে দুর্গা মেরেছে ঝাপটা” দিন আমাদের আসেনি। আমাদের মাথার ভেতর কল্পনাতেই আমরা দুর্গা হয়ে উঠতে চেয়েছি কেবল।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]