November 21, 2024
কলামফিচার ২

নারীর প্রতি বৈষম্য প্রতিষ্ঠার জন্যই কি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন!

মাসকাওয়াথ আহসান ।। টাঙ্গাইলের সখীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদকে গার্ড অব অনার দিতে যাওয়ায় নারী ইউএনও’কে বাধা দিয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।

কাদের সিদ্দিকী একজন পুরুষ কর্মকর্তাকে দিয়ে গার্ড অব অনার দিতে বলেন। এরপর ইউএনও চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে অবশ্য কাদের সিদ্দিকী চলে যাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ইউএনও’র নেতৃত্বেই রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের পর ওই মুক্তিযোদ্ধাকে দাফন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী (বাঘা সিদ্দিকী)’র অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে জাতির জনক আহ্বান জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে বসবাসকারী অ-বাঙ্গালিদের ওপর যেন কোনো আঘাত না আসে।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হবার পরেই আইন-আদালতের তোয়াক্কা না করে; বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা না করে; কাদের সিদ্দিকী কয়েকজন বিহারী রাজাকারকে ঢাকা স্টেডিয়ামে নিয়ে গিয়ে প্রকাশ্যে শাস্তি দেন। এই “মানবতাবিরোধী অপরাধের বিপরীতে মানবতাবিরোধী অপরাধের ছবি” আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। চোখের বদলে চোখ নিতে অন্ধ মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকী গোটা বিশ্বের মানুষের বাঙ্গালির প্রতি সহানুভূতিকে যেন এক লহমায় ম্লান করে দিয়েছিলেন ঐ ঘটনায়। এশিয়ার ইতিহাসে বাঙ্গালির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি খুনে সেনার রাক্ষুসে হত্যাযজ্ঞ সবচেয়ে বড় গণহত্যা। অথচ কাদের সিদ্দিকীর মতো যুদ্ধের আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে কম অবগত মানুষের বিহারী হান্টিং-এর হঠকারিতা; গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পথে অন্যতম বাধা হয়েছে বলে মনে হয়।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তিনি নিজের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছেন। জনগণের সেবা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রতিক্রিয়াশীলতা এক অবিশ্বাস্য মেটামরফসিস যেন।

যুদ্ধ বিজয়ের পরেও আত্মসমর্পণকারী নিরস্ত্র “বিহারী”-র রক্তের দাগ হাত থেকে মোছার জন্য কিনা জানিনা; উনি আধ্যাত্মিকতার পথে হেঁটেছেন। যাপিত জীবনে ধর্মীয় শুদ্ধাচারের অনুসন্ধান করেছেন। ২০০১ সালে বিটিভিতে দায়িত্ব পালনের সময় কয়েকঘন্টা উনার সঙ্গে সময় কাটনোর সুযোগ হয়েছিল। সজ্জন-সদালাপী মানুষ। তাঁর মেধা-বিনয়-স্নেহ এসব গুণ দেখে বঙ্গবন্ধুর যোগ্য শিষ্যই মনে হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯-এর পরে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী জামাতের সহমত মিডিয়া দিগন্ত টিভিতে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তা বেশ কিছুটা অবাক করেছিল আমাকে।

সাম্প্রতিক সখিপুরের ঘটনাটি হয়তো আমাদের সঙ্গে উনার প্রজন্ম ব্যবধান। আমাদের ধর্ম নারীর মর্যাদা নানাভাবে ওপরে রাখলেও এর কোনো কোনো অনুশীলনে নারীকে অবরোধবাসিনী করে ফেলার মনোভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। সৌদি আরবে হজব্রত পালনে নারী-পুরুষের সহাবস্থান সম্ভব হলেও মসজিদের নামাজ ও কেউ মারা যাবার পর জানাজা নামাজে নারীর অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা কেন, এ প্রশ্নের উত্তর আজো পাইনি।

কিছুদিন আগে তুরস্কের একটি মসজিদে নারী-পুরুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তে দেখেছি; আরেকটি মসজিদে এশার নামাজের পর নারী-পুরুষ কোরাসে হামদ-নাত আবৃত্তি করতে দেখেছি। আরেকটি মসজিদে মর্সিয়া বা শোকগাঁথা গাইতে দেখেছি হালকা বাদ্য সহযোগে। পৃথিবীর নানা জায়গায় ইসলামে নারীর উচ্চ অবস্থান, এমনকি পুরুষের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখে মনে হয়েছে, প্রথম নারী মুসলমান বিবি খাদিজার মতো আত্মনির্ভর উন্নয়ন কৌশল অনুসন্ধানী নারী তারা। মহানবী হজরত মুহম্মদ (শান্তি বর্ষিত হোক) বিবি খাদিজার মতো স্বনির্ভর ব্যবসায়ী নারীর তেজোদীপ্তিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন। নবীজী তাঁর মেয়ে বিবি ফাতেমার বিয়ের জন্য হজরত আলীর মতো শিক্ষিত পাত্র খুঁজেছিলেন, যিনি নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল, আত্মবিশ্বাসী ও উদার।

ইসলাম ধর্মের জেনেসিস অনুসন্ধান করে, দেশে দেশে নারীর মর্যাদা ও সম্মান দেখে তারপর নিজের সমাজের দিকে তাকিয়ে আমার কেবলই ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র লালসালু উপন্যাসের কথা মনে হয়। মজিদ-সমাজ যেভাবে ধমক দেয়, অমন কইরা হাঁটিওনা বিবি মাটি গোস্বা করে।

নারীর চলন-বলন, ওড়না নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত থেকে আমরা জানতেও পারলাম না কবে কবে; মুসলিম বিশ্বের দোহা-দুবাই শিক্ষা-বিজ্ঞান গবেষণার উজ্জ্বল কেন্দ্রে পরিণত হলো, যেখানে নারীর উজ্জ্বল উপস্থিতি দৃশ্যমান।

আর একজন নারী ইউএনও রাষ্ট্র প্রোটোকল অনুযায়ী প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাকে শেষ সম্মান জানাতে গার্ড অফ অনার পরিচালনা করতে গেছেন; শ্রদ্ধেয় কাদের সিদ্দিকী সেটা মানতে পারেননি। উনি পুরুষ অফিসার পাঠাতে বলেছেন। নারী ইউএনও’কে বদলী করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। এরকম একটি নারীর প্রতি বৈষম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কী মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকী জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন! ঐ নারী ইউএনও জানাজা নামাজে অংশ নিতে যাননি। গিয়েছেন কেবল গার্ড অফ অনারে নেতৃত্ব দিতে।

মি সিদ্দিকীর এই অযৌক্তিক আচরণ দেখে মনে হলো – এ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্য, যে কোনো অনুষ্ঠানে একজন মুরুব্বি খালু বা ফুফা রেগে না উঠলে অনুষ্ঠানের সবগুলো রিচুয়াল যেন পূর্ণ হয় না।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *