টেস অভ দ্য ডারবারভিলস-গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো
কানিজ ফাতেমা শিরিন ।। বিখ্যাত লেখক থমাস হার্ডির টেস অভ দ্য ডারবারভিলস পড়লাম। প্রধান চরিত্র টেস। আজ লিখবো তাকে নিয়ে। পরিবারের বড় মেয়ে। উপার্জনের সবরকম পথ বন্ধ হয়ে গেলে সে-ই সংসারের হাল ধরেছিলো। বিভিন্ন সময় আমরা বিভিন্ন চরিত্রের প্রেমে পড়ি। কিছু চরিত্র আমাদের উপর দীর্ঘ সময় প্রভাব রাখে। টেস হচ্ছে এমনই একটা চরিত্র। টেসের চরিত্রের মাঝ দিয়ে বারবার যেটা অনুভব করলাম, সেটা হচ্ছে “woman pays”। এই সমাজে নারীর সাথে যা কিছুই ঘটুক না কেন, এর জন্য মূল্য দিতে হবে শুধুমাত্র নারীকে। যেটা আমরা আমাদের সমাজের নারীদের ক্ষেত্রেও দেখতে পাই। ধর্ষিত হয় নারী, দোষও হয় নারীর, জীবনভর বাজে মন্তব্যের মধ্যদিয়ে যেতে হয় সে নারীকেই। টেস এই গল্পে আমাদের সমাজের নারীদেরকে প্রতিনিধিত্ব করে। গল্প শেষে আমাদের সহানুভূতি তার প্রাপ্য। নারীরা সেটা পায় না। সবসময় পায় শুধু লাঞ্ছনা আর কটুক্তি। আর অ্যালেকরা প্রতিনিয়তই চারপাশে ঘোরে ফেরে।
দরিদ্র এক পরিবারের বড় মেয়ে টেস। পরিবারের হাল ধরার কথা ভাবতো সবসময়। পোল্ট্রি ফার্মে কাজ করতে গিয়ে অ্যালেক কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়। The maiden no more! টেসের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। সে একটা বাচ্চার জন্ম দেয়, বাচ্চা মারা যায়। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর এতো এতো কটুক্তি শুনে নিজ সমাজে বাস করতে পারেনা। সিদ্ধান্ত নেয় এমন কোথাও যাবে যেখানে তাকে কেউ চিনবে না।
টেস যেখানে গিয়েছিল, সেখানে এঞ্জেল নামে এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়। ভদ্রলোক তার প্রেমে পড়ে। দূর থেকে প্রেমে পড়া সহজ, কিন্তু কাছে এসে ভালোবাসার মানুষ খুব কম। টেসও এঞ্জেলকে পছন্দ করে। নিজের অতীতের কথা ভেবে কোনোভাবেই এঞ্জেলকে ধরা দিচ্ছিল না সে। বিভিন্নভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত সেই ঘটনা জানাতে চায় তাকে, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। টেস চিঠি লিখে। চিঠিটা এঞ্জেলের দরজার নিচে রেখে যায়। দূর্ভাগ্যক্রমে চিঠি চলে যায় কার্পেটের নিচে, কোনোভাবেই জানাতে পারলো না৷ টেস আর এঞ্জেলের বিয়ে হয়। নতুন অধ্যায়ের শুরুতে অন্তত দোষ-ত্রুটির স্বীকারোক্তি করবে। টেস শুরু করার আগেই এঞ্জেল তার বিয়ে বহির্ভূত এক অবৈধ সম্পর্কের কথা জানায়। টেস তাকে ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু টেস যখনই নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়ের কথা জানায়, প্রচলিত নিয়মে ভার্জিন না হওয়ায়, এঞ্জেল তাকে ছেড়ে চলে যায়। নারী-পুরুষের অপরাধ বা ভুলের আলাদা বিচার। এঞ্জেল ক্ষমা পায়, আর টেসকে এর জন্য পেতে হয় গুরু শাস্তি। নারীরা ভুল করতে পারবেনা, আর যদি অসতর্কভাবে করে ফেলে, সেটা ক্ষমার অযোগ্য। নারীকে অতীত দিয়ে মাপা হয়। যদি অতীত থাকে, তাহলে সে কখনোই ভালো বউ হতে পারে না। ছেলেদের অতীত না দেখলেও চলে। অতীত থাকলেও তারা সবসময় চরিত্রবান সুপুরুষ বটে।
ভাগ্যবিড়ম্বিত টেস স্বামীর অবহেলা পেয়ে অ্যালেকের খপ্পরে পড়ে আবার। এবার সে ঝোঁকের মাথায় অ্যালেককে খুন করে। এঞ্জেল ফিরে আসে। খুনের দায়ে টেসের ফাঁসি হয়। অমর দেবতারা হেসে ওঠে। She is more sinned against than sinning. তার নিজের করা পাপের থেকেও তার উপর করা পাপের পাল্লা ভারি। টেস যখন ধর্ষণের শিকার হয়েছিল, অ্যালেক দিব্যি এই জগৎ সংসারে স্বাধীনভাবে বেঁচে ছিল। ভুগতে হয়েছে টেসকে। অপরাধীরা ডানা ছড়িয়ে উড়ে বেড়ায়, আর ভিক্টিমকে হতে যেতে হয় আলাদা। টেসকেও তাই পরিবার, সমাজ সব ছেড়ে দূরে চলে যেতে হয়েছিল। এঞ্জেলের ক্ষেত্রেও আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একই চিত্র দেখতে পাই। সে ভদ্রলোক, কিন্তু টেসকে বিয়ে করে প্রচলিত নিয়ম ভাঙার মতো সাহসী হিরো সে নয়। ভার্জিনিটির সংজ্ঞাটাও নারী-পুরুষের জন্য আলাদা, আর সেটা ঠিকও করে দেবে পুরুষ।
টেস সৎ ছিল। তার সাথে যা হয়েছে, অন্যায় হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই এর জন্য মূল্য দিতে হয়েছে তাকে। আমাদের সমাজের চিত্রগুলোও তেমন। উপন্যাসটা ১৯ শতাব্দীতে লেখা হলেও, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টায়নি। একটা উপন্যাস শুধুই উপন্যাস না, এটা একটা জীবনের গল্প। এই উপন্যাসও জীবনের কথা বলে। যা-ই ঘটুক, সব কিছুর জন্য দায়ী নারী। দু’পক্ষে ঘটা একই কাজের জন্য একটা মেয়েকে যতোটা ভুগদে হয়, প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, ছেলেদের তা হতে হয় না। এজন্য মেয়েরা তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। এতে ছেলেরা আরো বেশি অপরাধ করার সাহস পায়, আর সেই অপরাধ গিয়ে পড়ে নারীর ঘাড়ের উপর। সমাজ চলে কিছুটা উপপাদ্যের প্রমাণের নিয়মে। ঘুরেফিরে প্রমাণ করতেই হবে, দোষ মেয়েটার।
টেস প্রচলিত নিয়মে এই সমাজের চোখে ভার্জিন না। কিন্তু আমার চোখে উপন্যাসের চরিত্রে অমর চরিত্র। WOMAN PAYS! SHE PAID!
কতোটুকু মূল্য দিয়েছে? এইতো – এক জীবন! যথেষ্ট নয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আরো অনেক জীবন চাই।
গল্পটা অন্যরকমও হতে পারতো। টেসকে ধর্ষণ করার দায়ে শাস্তি হতো অ্যালেকের। টেসকে একটা সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন দেয়া হতো। সে সমাজের বাকি মানুষগুলোর মতোই বাঁচতো। এই সমাজ জানতো, যে শরীর পচে যায়, গলে যায়, পুড়ে যায়, ঝুলে যায়- তা দিয়ে মানুষকে বিচার করতে নেই। এঞ্জেল একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে টেসকে বিয়ে করতো। যা কিছুর জন্য টেস দায়ী নয়, তা নিয়ে তাকে কোনো দায়ী করা হতো না। টেসের বাচ্চার নাম হতো সুখ।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]