November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

পুড়িয়ে ফেলা ডাইনিদের রক্ত নিয়ে জন্মেছি, তাই…

প্রিয়া দেব ।। জীবনের মোটামুটি দীর্ঘ একটা পথ পাড়ি দিয়ে খেয়াল করলাম আমি এ বছর আমার জীবনের তেইশতম নারী দিবস পালন করবো।

এই দিবস নামক ব্যাপারগুলো আসলেই আমাদের দেশের কিছু মানুষ বলতে শুরু করেন আলাদা করে নাকি পালনের জন্য দিবস লাগে না। নারী দিবসের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে, অনেকে বলেন নারীকে সম্মান জানানোর জন্য নাকি আলাদা করে দিবসের প্রয়োজন হয় না।

সত্যিই কি তাই? আমার তো মনে হয় এই একটি দিন আসলে আমি আমার পরিচিত সব নারীকে ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করি, আদতেও তারা জানেন কিনা এই দিবস সম্পর্কে? ওইদিন কি তারা ফুল কিনে উপহার দেন নিজেকে কিংবা কোনো কফিশপে বসে একটু সময় নিজের জন্য রাখেন?

আমার তো মনে হয়না এই দেশের সিংহভাগ নারী এই কাজগুলো কখনো করেছেন! বরাবরের মতোই ৮ মার্চ সকালটা তাদের কাছে আর পাঁচটা স্বাভাবিক সকালের মতোই। তারা ঘর সামলান, বাচ্চা সামলান, কাজ করেন, চাকরীজীবী নারী হলে অফিস করেন, অফিস শেষে আবার ঘরের কাজে মন দেন। ওইদিনও নারীরা প্রশ্ন করেন না অফিস শেষ করে এসে রান্নাঘরে কেন তাকে একা যেতে হয়, ঘরে তার মতো একইভাবে ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফেরা পুরুষটির জন্য কেন বরাদ্দ থাকে বিশ্রাম? কিংবা স্কুল কলেজগামী ওই কিশোরী বা তরুনীটি পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে ভিড় ঠেলে যখন রাস্তায় হাঁটেন তখন অপ্রত্যাশিত নোংরা স্পর্শের শিকার কেন খালি তাদেরকেই হতে হয়।

আমি আমার তেইশ বছরের জীবনে সবকিছুকে ছাপিয়ে প্রশ্ন করতে শিখেছি। আমি কথায় কথায় জানতে চাই কেন চুলার আগুনে তেতে পুড়ে একশো পদের কঠিন রান্না করে ঘরের পুরুষটিকে তৃপ্ত রাখতে হয়? কেন তাদের হাতে বাটা মশলা ভালো লাগে রান্নায়? তারা কখনো জানতে চায় ওই মশলা বাটতে গিয়ে হাতে কতটুকু ব্যাথা লাগে তাদের মায়েদের, স্ত্রীদের কিংবা বোনেদের? ওই পুরুষেরা কখনো ভেবে দেখেছেন কি – কেন অফিস শেষ করে ঘরে ফিরলে বিশ্রামটা শুধু তাদেরই কেন প্রাপ্য থাকে? কেন সংসারে নারী চুপ করে থাকলেই সুশীলা উপাধি দেওয়া হয়? আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করা মেয়েটিকে শুনতে হয় নোংরা গালি?

আমি এরকম বহু প্রশ্ন করা শিখেছি, আর এই শেখার জন্য নোংরা সব গালি আর উপাধি আমি এই স্বল্প জীবনেই অর্জন করেছি। আমাকে সস্তা নারীবাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, আমাকে সহজেই বলা হয়েছে বাজারের বেশ্যা এবং ওই নারীবাদী শব্দটারও বিশেষ উচ্চারণ হিসেবে “ন্যাড়িবাদি” বিশেষণ আমি পেয়েছি।

আমি এতে কখনোই অপমানিত অনুভব করিনি। ইতিহাস সাক্ষী, পৃথিবীর যেসব নারীরা আওয়াজ তুলেছেন সমান অধিকারের জন্য তাদের প্রত্যেকের জন্যই বরাদ্দ ছিল এরকম টিটকারি। এ বঙ্গের প্রথম নারী ডাক্তারটিকে সমাজের উচ্চস্তরের পুরুষরা বেশ্যা বলে ডাকতেন, পৃথিবীর আরেক কোণে জ্ঞান আর প্রজ্ঞায় এগিয়ে থাকা নারীদের পুড়িয়ে মারা হতো ডাইনী অপবাদ দিয়ে, এই আমার দেশেই প্রচলিত ছিল নারীরা পড়াশুনা করলে নাকি স্বামী দ্রুত ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে পাড়ি জমান। যুগে যুগে নারীদের দমিয়ে রাখার জন্য এমন কোনো প্রচেষ্টা নেই যা করা হয়নি। তবুও কিছু নারী কথা বলেছিলেন বলেই পৃথিবীতে পরিবর্তন এসেছে। এই নারী দিবসের গল্পটাও এমন, ১৯০৮ সালে কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, বেতন বৃদ্ধি এবং ভোটাধিকারের দাবিতে প্রায় ১৫ হাজার নারী নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় আন্দোলনে নামে। মূলত এই আন্দোলনের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল নারী দিবস পালনের মূলমন্ত্র। এই আন্দোলনের এক বছর পর আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি সর্বপ্রথম জাতীয় নারী দিবস ঘোষণা করে।এই নারী দিবস বহু মানুষের কাছে আদিখ্যেতা, নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলাটাই এদেশে আদিখ্যেতা।

এই দেশে কিছু হলেই আঙুল ওঠে নারীর দিকে। তিশা মোশতাক নামক দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নরনারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন, সাথে সাথে নারীকে গোল্ডডিগার আখ্যা দিয়ে আলাপ শুরু হয়ে গেল দেশজুড়ে। যারা আলাপে অংশ নিলেন তারা জানেন না এ দেশে কতজন মেয়ে বিজ্ঞানী আছেন, তারা জানেন না এদেশে কতজন নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হন,তারা জানেন না এদেশে ম্যারিটাল রেইপের হার কতো, তারা এটাও জানেন যে এই দেশে কত শতাংশ পুরুষ বিদেশে গেলে নাগরিকত্বের লোভে বয়স্কা নারীদের বিয়ে করেন। তারা খালি জানেন তিশা নামক একটি আঠারো বছরের মেয়ে মোশতাক নামক এক বৃদ্ধকে তার পয়সার জন্য বিয়ে করে বসে আছে। এইখানেও আঙুল ওই মেয়েটির দিকেই।

এমন এক জাতি মেয়েদের দিকে আঙুল তোলে যে জাতির আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গর্ববোধ করতে হয় নারী বিজ্ঞানী দিয়ে, নারী ক্রিকেটার দিয়ে, নারী ফুটবলার দিয়ে। এই এমন হিপোক্রেট এক জাতির মাঝখানে বসে আমি আরো অনেকের মতো স্বপ্ন দেখি নারীমুক্তির। যে নারীমুক্তির কথা শুনলেই এই জাতি ভাবে এই বুঝি নারীকে ইচ্ছেমতো পোশাকের স্বাধীনতা দিয়ে দেওয়া হলো, এই বুঝি নারীটি চেয়ে বসলো ইচ্ছেমতো রাতের বেলা ঘরে ফেরার অধিকার, এই বুঝি নারীটি ছুড়ে ফেলে দিল তাদের বহুল আরাধ্য সুশীলা নারীর খোলসকে। এবং এই নিয়ে কোনো নারী কথা বলতে গেলেই তার চরিত্রকে আঘাত করার জন্য তৈরি থাকে এ জাতি।

আমি এভাবেই বড় হয়ে উঠেছি, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছি প্রতিনিয়ত নিজের নারীবাদী পরিচয় নিয়ে। কিন্তু তারপরও আমি স্বপ্ন দেখা ছাড়িনি। আমি স্বপ্ন দেখি নারী পুরুষের জন্য সমান পৃথিবীর, বাসের আলাদা করে নারী সিট বাদ দিয়ে এমন এক বাসের কথা ভাবি যে বাসে নারী দাঁড়িয়ে থাকলে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো স্পর্শ ওই নারীর রাতের দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়াবে না। আমি স্বপ্ন দেখি স্বাবলম্বী ওই নারীটিকে, যিনি কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমান বেতন পান, যাকে অফিসে প্রমোশন পেলে শুনতে না হয় এই প্রমোশন নারীটির প্রাপ্য নয়। নারীদিবসে এই দেশের নারীরা একদিন নিজের জন্য ভাবার সময় রাখুক। ওইদিন তারা খুঁজে দেখুক জীবনের অংকের হিসেবে ঠিক কোথায় কোথায় ঠকে গেছে তারা অনায়াসে। তাদেরকে সামাজিক সুশীলার স্বীকৃতি দিয়ে যারা মুখ বন্ধ করতে বলেছিল, ওই মানুষগুলোর এই স্বীকৃতি দিয়ে তারা আসলে এই জীবনে পেলটা কী – এই প্রশ্ন তারা করতে শিখুক। যে ছোট মেয়েটি কিশোরী হবে কিছুদিন পর সে প্রশ্ন করতে শিখুক তার কর্মজীবী মাকেই কেনো রান্নাঘরে ছুটতে হয় অফিস থেকে এসে, যে নারীটি নিজের সবকিছু দিয়ে সাজিয়ে রাখেন পুরো বাড়ি, সেই নারীটিকে যখন প্রশ্ন করা হয় “সারাদিন বাসায় বসে কী করো?” তখন ওই নারীটিও যেন এই ঘরের কাজের জন্য প্রাপ্য সম্মানী দাবি করে বুঝিয়ে দেন শুধু ভাত কাপড় দিয়ে আস্ত একটা মানুষকে চাকর হিসেবে কিনে নেওয়া যায় না। ভিড়ের মধ্যে নোংরা স্পর্শের প্রতিবাদে যে মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠে প্রতিবাদ করে সেই মেয়েটির আওয়াজ দেখে আশপাশের মানুষ যতই “বাড়াবাড়ি” বলে নাক সিটকে নিক, ওই মেয়ের পাশে যেন বাকি মেয়েগুলো সগর্বে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তোলার ক্ষমতা রাখে। নারীর পোশাক দেখে যারা চরিত্রকে কাঁটাছেড়া করতে নামে, তাদের এই মুখ বন্ধ করতে যেন সব নারী এক হয়ে প্রতিবাদ করে।

পরিবর্তন এভাবেই এসেছে, পরিবর্তন এভাবেই আসবে। আমি আজ থেকে দশ বছর আগে আমার আশেপাশে হাতে গোণা কয়েকটা অধিকার সচেতন মেয়েকে চিনতাম, আজ দশ বছর পর সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। সেইসব মেয়েরা আমাকে অনুপ্রেরণা জাগায়, এই মেয়েগুলোর চোখেমুখে উপচে পড়া আভা দেখলে আমার সত্যিই বিশ্বাস করতে মন চায় এরা সেই আঠারো শতকে পুড়িয়ে ফেলা ডাইনীদেরই রক্ত নিয়ে জন্মেছে, এদের এত সহজে পোড়ানো যাবে না। সবশেষে সেই সকল ডাইনীদের জন্য নারীদিবসের শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *