‘‘ওরা খারাপ, ওরা শুধু এগুলোই বোঝে”
জাহারা আলম ।। কোনো এক ১৭ ই মার্চ, জাতীয় শিশু দিবস। উদযাপনের ধুম লেগে গেছে। কে গান গাইবে, কে কবিতা আবৃত্তি করবে তা নিয়েই ব্যস্ত সবাই। রাস্তায় রাস্তায় শোভাযাত্রা হয়, শিশু দিবস বলে চিল্লানো হয় – আবার সেই রাস্তার পাশের দোকানগুলোতেই শিশুরা চা বানায়, হাতুড়ি পেটায়। মানুষজন ব্যানার বানায়, পোষ্টার বানায়, রাস্তা নোংরা করে, পরে টোকাই ছেলেটা গিয়ে তা সংগ্রহ করে।
শিশু দিবস পালন করার জন্য সবার কত উদ্দীপনা স্কুল-কলেজগুলোতে। কিন্তু সেই শিশুদের খবর কে রাখে?
কলেজে সেদিন প্রোগ্রাম ছিল। আমিও দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখলাম। সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল, শুক্রবার কলেজ বন্ধ। ব্যাগ -ট্যাগ গুছিয়ে হোস্টেল থেকে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
আসার সময় আমাদের বাড়ির রাস্তায় এক মহিলাকে দেখলাম। মহিলাটির বয়স বোধ করি পঞ্চাশ বা তার কাছাকাছি হবে। মহিলাটির নীল রঙের ম্যাক্সি পরনে ছিল। তার ওপর সাদা রঙের মোটা এবং নোংরা একটা সোয়েটার পরেছিল। তার চুলগুলো সম্ভবত এক ইঞ্চি লম্বা হবে। দেখে মনে হলো পাগল।
বাড়ি গিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম সেই মহিলার কথা ,বাবা বললো চারদিন হলো সে আসছে।
তার কাছে গেলাম, তার নাম জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ি কোথায় তা জিজ্ঞেস করলাম, কোনো উত্তর পেলাম না। ভাবলাম বোবা হয়তো।
পাশেই একটা ঘর ছিলো, যেখানে পাইকারি হিসেবে ধান কিনে এনে রাখা হতো। সেখানে কিছু মহিলা কাজ করতো।তারা আমাকে বললো, “এই পাগলি তো কিছুই খায় না, কথাও বলে না। আমরা কত কথা বললাম, তার কোনো উত্তরই দেয় না।”
পরে তার খাওয়ার জন্য কিছু নিয়ে গেলাম, তখন নিলো। তারপর আমাকেই বলতে লাগলল,” নেও, নেও নেও, তুমি খাও।”
ভাবলাম, আমার সাথে যেহেতু কথা বললো, দেখি সে তার বাড়ির ঠিকানা বলে নাকি।
আমার সাথে সে স্বাচ্ছন্দ্যে আলাপ জুড়ে দিল। আগেও তো কত পাগল রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখতাম কিন্তু আগে কারও সাথে এভাবে কথা বলিনি।
তার সাথে আমার প্রচুর ভাব জমে গেল, যেন পূর্ব-পরিচিত। তাদের বাড়ির কালুমিয়ার গল্প শোনালো আমাকে। আমি দাঁড়িয়েছিলাম, আমার হাত ধরে তার পাশে বসালো। আমিও বসলাম। রাস্তা দিয়ে যাওয়া এলাকার লোকগুলো ইয়ার্কি করে বলতেছিল, জাহারা তোর বান্ধবী নাকি এইটা!
আমার ভালোই লাগতেছিল। কোনো পাগল আমার সাথেই শুধু কথা বলে আর কারও সাথে বলে না। তার বন্ধু হওয়াটা মন্দ কিছু না।
প্রথমে তার নাম জুঁই বললো, পরে বললো তার নাম মমতা। তার স্বামীর ক্যান্সার। তার মাথায় হাত দিয়ে বললো, ‘‘এইখানে বাড়ি দিয়ে আমার মাথা ফাটাইছে।”
তার কথাগুলো স্পষ্ট ছিল না। ছেলে- মেয়ে, স্বামী সবাই তার গায়ে হাত তুলতো। আমি বারে বারে তার বাড়ি কোথায় তা জিজ্ঞেস করতেছিলাম। আর সে তার মতো বলেই যাচ্ছে। তার ভাইয়ের নাম জমক। তারপর আবার বলতেছে তার স্বামী মাগুর মাছ বিক্রি করতো। তার ছেলে মেয়ে মারা গেছে। সম্ভবত সে আবোল- তাবোল বলছিল।
পরবর্তীতে বললো, “দৌলতপুর এয়ারপোর্টের কাছে আমার বাড়ি, আমার মাথার ওপর দিয়া বিমান যায়।”
পরে এক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম দৌলতপুরে কোনো এয়ারপোর্ট আছে কি না। সে বললো, আছে।
সে কিছু কথা তো সত্য বলছে আর কিছু কথা হয়তো বা আবোল তাবোল বলতেছে। তাকে যখনই জিজ্ঞেস করতাম, আপনি খাইছেন? কিছু না খাইলেও বলতো, মুরগির মাংস দিয়ে খাত খাইছি। ফেসবুক গ্রুপে তার ছবি দিয়ে পোস্ট করলাম। পোস্ট এপ্রুভ হলো না।
বিকেলে তার কাছে গেলাম। পাশ দিয়ে কিছু লোক যাচ্ছিলো। লোকগুলোকে দেখে সে কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল।জরোসরো হয়ে যাওয়া, তার চোখে ভয় – এগুলোর কারণ কী!
তার শরীরের বিশেষ অঙ্গগুলোতে হাত দিয়ে বললো, “ওইদিকে যাইয়ো না, ওরা খারাপ, ওরা শুধু এগুলোই বোঝে।” তখন আরও কিছু কথা বলছিল। আমি বুঝলাম তার সাথে এমন কিছু হয়েছে যে কোনো পুরুষ দেইলেই সে ভয়ে শিউরে ওঠে। তখন একটু সময়ের জন্য আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। সে আমাকে যেভাবে সাবধান করেছিল তা আজও আমাকে ভাবায়। প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে, কিন্তু ভুলতে পারিনি কথাটা “ওরা খারাপ, ওরা শুধু এগুলোই বোঝে”।
সন্ধ্যার দিকে আবার গেলাম, তখন তাকে আর দেখতে পেলাম না। শুনলাম বাজারে স্কুলের বারান্দায় আছে।পরের দিন সকালে তাকে আর কোথাও পেলাম না, বাজারেও নাই। ফেসবুকে দেওয়া পোস্টটা ডিলিট করলাম। সে হয়তো বা কোনো অজানা গন্তব্যে গেছে। তার কি বাড়ি ফেরা হবে না আর! রাস্তায় রাস্তায় পুরুষের ভয়ে ভয়েই কাটিয়ে দিতে হবে জীবন!
যারা রাস্তায় রাস্তায় পাগল হয়ে ঘোরে, তাদেরও তো একটা বাড়ি ছিল। তারাই রাস্তায় ধর্ষণের শিকার হয়। অনেকের কোলে ছোট ছোট বাচ্চা দেখা যায় কিন্তু পিতৃপরিচয় নেই। এই পুরুষগুলো তো আমাদের সমাজেই থাকে। এর কি কোনো শেষ নাই? আর কতযুগ নাকি আর কত শত বছর চলবে এভাবে!