November 21, 2024
মুক্তমত

মমতা শঙ্কর মেধাবী হলেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই

জাকিয়া সুলতানা মুক্তা ।। খ্যাতিমান অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী মমতা শঙ্কর তাঁর শাড়ির আঁচল নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য নিয়ে আবারো আত্মপক্ষ সমর্থণ করে একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন, দেখলাম; এবং আমি অবশ্যই তাঁর সব বক্তব্যের বিপক্ষে অবস্থান করছি। কেননা একবিংশ শতাব্দীর এই আধুনিক যুগেও ‘সেক্স সিম্বল’ হিসেবে বিবেচিত হওয়াই যদি ভালো নারীর বৈশিষ্ট্য বলে ধরে নিতে হয়, তবে নারীর মেধার এত চর্চা মূল্যহীন। নারী চরিত্রের হিসাব-নিকাশ যেমন তার পোশাকের ধরন-ধারণে লুকিয়ে থাকে না, তেমনি তার শরীরের ভাঁজেও তা আবদ্ধ নয়।

উল্লেখ্য পোশাক পরাকে সভ্যতার চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা না করে বরং একে কৃত্রিম মনুষ্য জীবন যাপনের চিহ্ন ধরে নেওয়াটা যৌক্তিক। এর সাথে সভ্যতার কোনো সংযোগ নেই। আদিম মানুষেরা অসভ্য ছিল না, বরং তারা প্রাকৃতিক ও অকৃত্রিম জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। এখনও আদিম জীবন যাপনে অভ্যস্ত বহু মনুষ্য জাতিগোষ্ঠীর হদিস এই শতাব্দীতেও পাওয়া যাবে। ওইসব আদিম জীবন প্রণালীতে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীর মাঝে নারীকে তার পোশাক দিয়ে, তার শরীর বাঁক বিবেচনায় বিবেচিত হতে হয় না। বরং সভ্যতার নামে নারীকে যেভাবে নিষ্পেষিত হতে হচ্ছে, সেই নিপীড়ন সভ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। বরং বহু তথাকথিত আদিম ‘অসভ্য সমাজে’ই নারী স্বাধীন জীবনে অভ্যস্ত। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ সভ্যতার স্পর্শবিহীন ওইসব সমাজে তুলনামূলক অনেক কম।

ওদের কথা যদি বাদও দিই। নারীর স্বল্প পোশাক উন্নত বিশ্বে কোথাও তো চরিত্রের ধারক হতে উঠতে পারেনি। তবে এই পশ্চাৎপদ সমাজে কোন যোগ্যতার বিবেচনায় নারীকে মূল্যায়নে মমতা শঙ্করের এহেন দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন দিতে হবে? এই সমাজ নারীকে পোশাক বিবেচনায় চারিত্রিক প্রত্যয়নপত্র দিয়ে, সমাজকে ঠিক কোন ধরনের অনুসরণীয় উদাহরণ দিতে পেরেছে? এতে কি তারা পেরেছে নারীকে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে আসীন করতে? পেরেছে নারীকে সত্যিকারের নিরাপত্তা দিতে? পারেনি তো! বরং যেখানে নারীর স্বাধীনভাবে পোশাক পরিধানের সুযোগ রয়েছে, হোক সেটা ঢাকা বা মুক্ত; সে সমাজই অনেক বেশি সাবলীল।

মমতা শঙ্কর অনেক গুণী শিল্পী হতে পারেন, কিন্তু তিনি মনে-প্রাণে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ মানসিকতার মানুষ। তাঁর ভাবনার জগৎ অত্যন্ত জাজমেন্টাল, যা শিল্পী হিসেবে তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে যথেষ্ট। তাঁর মেধা নিয়ে প্রশ্ন নেই, কিন্তু তাঁর দর্শন নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন তোলা যায়। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত চর্চার একটা শৈলী দাঁড় করাতেই পারেন, তাই বলে সে চর্চা দিয়ে অন্যকে অবলীলায় অসম্মানিত করার প্রচেষ্টা নিতে পারেন না। কেননা তিনি যা বলতে চেয়েছেন এর ব্যাখ্যা দাঁড়ায় – ‘শাড়ির আঁচল নামিয়ে বক্ষযুগল উন্মুক্ত করে পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাটাই একমাত্র সত্য, আজকালকার নারীদের অনেকেই এরকম করে অথচ পুরুষ এতে আকর্ষিত হলে সেই নারীরাই আবার ক্ষুব্ধ হয়; এমনটা কেন হয় এটাই তাঁর বোধগম্য নয়।’

এই ব্যাপারটা বোঝার জন্য বহুদূর ঘুরে আসার দরকার নেই, শিল্পী ও গুণীজন মমতা শঙ্কর!

সব নারীই পুরুষের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে জীবন যাপন করতে আগ্রহী নয়। তারা তাদের মন-মর্জি মাফিক জীবন যাপন করতে চায়। আপনার শিল্পচর্চা পুরুষের নিয়ম অনুসরণ করে আকর্ষণ ধরে রাখায় সীমাবদ্ধ, আর এখনকার সমাজের আধুনিকমনস্ক নারীরা বিশ্বাস করে পুরুষকে আকর্ষণ করাটা তাদের যাপিত জীবনের একমাত্র বা কোনোমাত্র উদ্দেশ্যের মধ্যেই পড়ে না। তাদের ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে নিজের স্বাধীন যাপন। শরীর তার, সৌন্দর্য চর্চা তার, পোশাক তার, পরিধানের পছন্দের মালিকও সে নিজেই। এতে কার শরীরের উত্তেজনা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে তা দেখার বিষয়টা নারীর নয়, বরং যে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে তার দায়িত্ব নিজেকে সামলানো এবং এই শিক্ষাটা অত্যন্ত জরুরি যে সম্মতি ব্যতীত কারোর প্রতি আকর্ষিত হওয়া যেতে পারে কিন্তু সে আকর্ষণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রকাশ করাটা অসভ্যতার নামান্তর।

শুধু পুরুষের চোখে ভালো নারীর চারিত্রিক প্রত্যয়ন নেওয়া বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাহিদা অনুযায়ী সেক্স সিম্বল হয়ে ওঠা কারু কারু জীবনের লক্ষ্য হতে পারে; কিন্তু মনে রাখতে হবে এরকম আত্মপরিচয়ের সংকট এখন বহু নারীর আর নেই। পুরুষের চোখ ধাঁধানোর লক্ষ্যে বা তাদের কামনার রঙে নিজেদের রাঙানোরই সব নারীর জীবনের মোক্ষ নয়।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *