নারীর প্রতি উত্তরাধিকার আইনের প্রহসন
আফরোজ ন্যান্সি।। নারীর সমান অধিকারের কথা আমরা অনেক বছর থেকে বলে আসছি। মানে পুরুষের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার অধিকার, চাকরির অধিকার, পথেঘাটে নিরাপদে চলার অধিকার এমন আরো অনেক কিছু। কিন্তু নারী অধিকারের বিভিন্ন দিকের মধ্যে সবচেয়ে কম উচ্চারিত অথচ গুরুত্বপূর্ন দিকটি হলো নারী ও পুরুষের সমান উত্তরাধিকারের অধিকার।
কথাগুলো বলার আগে আসুন জেনে নেই প্রচলিত আইন নারীর সম্পত্তি পাবার অধিকার নিয়ে কী বলছে ।
মুসলিম পারিবারিক আইন বলছে, পিতার সম্পত্তির ক্ষেত্রে একজন পুত্র যা পাবে তার অর্ধেক পরিমাণ সম্পত্তি পাবে কন্যা। একজন স্ত্রী তার স্বামীর সম্পদের আট ভাগের এক ভাগ পাবে। কিন্তু স্বামী তার স্ত্রীর সম্পদের চার ভাগের এক ভাগ পাবে। এমনকি মায়ের সম্পত্তির বেশি অংশও পাবে পুত্র। যে পিতার কোনো পুত্র সন্তান নেই তার সম্পদ পাবে ভাইয়ের ছেলে।
মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের পক্ষে যুক্তি দেয়া হয় যে, নারীকে দেনমোহর দেওয়া হয় এবং নারীর ভরণপোষণ পুরুষের দায়িত্ব, তাই পুরুষের বেশি সম্পদ পাবার অধিকার আছে। এই যুক্তি যে শতভাগ কুযুক্তি তা আমাদের চারপাশে একবার তাকালেই বোঝা যায়।
নারীর দেনমোহর বেশীরভাগ ক্ষেত্রে শুধু কাগজে কলমেই থাকে, বাস্তবে তা নারীর হাতে আসে না। আপনার- আমার মা, খালা, ফুপু, চাচী, মামী, দাদী, নানীর কয়জন তাদের দেনমোহর পেয়েছেন জানেন? আমিতো বেশিরভাগ নারীকেই স্বামীর মৃত্যুর পর কাঁদতে কাঁদতে “আমি সব দাবি ছাইড়া দিছি” বলতে শুনি। আর রইলো ভরণপোষণের কথা! এককালে আগে হয়তো নারীর ভরণপোষণের দায় পুরুষের ছিল, কিন্তু এখন তো নারী ঘরে বাইরে কাজ করে নিজেরটা নিজে করে খাচ্ছে, তাহলে সম্পত্তির অধিকারের বেলায় নারীকে ঠকানোর এই জোচ্চুরি বন্ধ না হওয়ার আর কী যুক্তি থাকতে পারে!
অন্যদিকে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে তো কন্যা কিংবা স্ত্রীর কোনো অংশই নেই। হিন্দু আইনে পিতার সকল সম্পত্তি পাবে পুত্র, পুত্রের পুত্র, পুত্রের নাতি এবং এরা কেউই যদি না থাকে তাহলে কন্যা সম্পত্তি পাবে ঠিকই কিন্তু সেক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে কন্যাকে অবশ্যই পুত্রবতী হতে হবে অর্থাৎ ঘুরেফিরে সম্পত্তি কিন্তু কন্যা পাচ্ছে না, পাচ্ছে তার ছেলে সন্তান।
এই বৈষম্যমূলক আইনগুলো নিয়ে আমরা উচ্চবাচ্য করিনা কেননা এর সাথে ধর্মের যোগসূত্র আছে, ধর্মগুরুরা এই আইনের প্রণেতা। ফলে এই আইনের সংস্কারের কথা বললে বেশিরভাগ লোকই ধর্ম অবমাননার প্রশ্ন তুলবেন। তাই পুরুষেরা তো বটেই নারীরাও এ নিয়ে কথা বলেন না ।
আমার মনে হয়, ধর্মের বিধান এক্ষেত্রে যতটা না বিবেচ্য তার থেকেও বেশি কাজ করে পুরুষতন্ত্রসৃষ্ট সংস্কার। পুরুষতন্ত্র আমাদের মস্তিষ্কে এটা গেঁথে দিয়েছে যে একজন নারীর সম্পত্তির বা বেশি সম্পত্তির প্রয়োজন নেই। কেননা নারীর ভরণপোষণ করবে পুরুষ। পিতা , স্বামী এবং পুত্রের আশ্রিত হয়ে একজন নারীর জীবনকাল অতিবাহিত হবে। নারী উদার হবে, সে সম্পদ দাবি করবে না, ছিটেফোঁটা যা পাবে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে, না পেলে আশ্রিতা হয়ে থাকবে, চাকরি করে নিজেকে স্বাবলম্বী করার নামে বেতনের পুরোটা খরচ করবে স্বামীর সংসারে। মূলত সম্পত্তির উপর নারীর কোনো অধিকার পুরুষতন্ত্র এলাউ করে না কেননা সম্পদের উপর দখলদারিত্ব ক্ষমতায় থাকার অন্যতম চাবিকাঠি।
আমরা বলছি নারীকে শিক্ষিত হতে। শিক্ষিত হয়ে নারী চাকরি করে যেন স্বাবলম্বী হয়। এটি খুবই ভালো । তবে সম্পদের উত্তরাধিকার পুরুষের যতখানি দরকার , নারীরও ততখানি দরকার, ক্ষেত্রবিশেষে আরো বেশি দরকার । অথচ আমরা তাকে দিচ্ছি কম , অথবা দিচ্ছিইনা ।
নারীর মস্তিষ্কে কতগুলো যুক্তি ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, নারীর সম্পদের দরকার নেই , নারী সম্পদের দেখভাল করতে অক্ষম, নারী সম্পদের যোগ্য উত্তরসুরী হতে পারে না। উপরন্তু কোনো নারী সম্পদের সমান অংশ দাবি যদি করেই বসে সেক্ষেত্রে সমাজ তাকে লোভী আখ্যা দিয়ে বসে। আর এই ভয়ে অনেক শিক্ষিত সচেতন নারীও সম্পদের সমান ভাগ দাবি করে না, পাছে পরিবারের লোকেরা তাকে লোভী মনে করে। এর ফলে কোনো নারী যখন তার পিতার গৃহে, স্বামীর গৃহে, পুত্রের গৃহে নিগৃহীত হয় তবু তার এখান থেকে বেরুবার উপায় থাকেনা কেননা তার আসলে নিজস্ব বাড়ি বা সম্পত্তি বলতে কিছু নেই।
এই ভ্রষ্ট আইনের সংস্কার হওয়া এখন এই যুগের দাবি, হোক কি মুসলিম আইন , কি হিন্দু আইন। সকল আইনে পুত্র এবং কন্যা যেন সমান অংশীদারিত্ব পায় , স্বামীর তার স্ত্রীর সম্পদের উপর যতখানি দাবি , স্ত্রীরও যেন তার স্বামীর উপর ততখানিই দাবি থাকে। এই সংস্কার হওয়াটা নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের স্বার্থে ভীষণ দরকারি।
আফরোজ ন্যান্সি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত]