মেনোপজ: যে বিষয়গুলো প্রতিটি নারীর জানা উচিত
ডা. শাফেয়ী আলম তুলতুল।।
মেনোপজ কী?
নির্দিষ্ট বয়সের পর প্রত্যেক নারীই মেনোপজের মধ্যে দিয়ে যাবেন। টানা একবছর সময় পিরিয়ড বা মাসিক (রজস্রাব) বন্ধ থেকে চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার নাম মেনোপজ।
মেনোপজ শরীরে নানা রকম পরিবর্তন আনে। উপসর্গগুলো ওভারি ( ডিম্বাশয়) থেকে নিঃসৃত ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন নামক দুটি হরমোন কমে যাওয়ার ফলাফল। খুব সাধারণ লক্ষনের মধ্যে আছে হট ফ্লাশ, ওজন বৃদ্ধি, ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস( যোনীপথের শুষ্কতা)। এরসাথে যুক্ত হতে পারে, যোনীপথের কোষগুলোর সংকোচন এবং প্রদাহ যা আপনাকে যৌন মিলন বা সঙ্গমে অস্বস্তিকর অনুভূতি তৈরি করতে পারে।
মেনোপজ হাড়ক্ষয়ের মত আরও কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। আপনি এটা উপলদ্ধি করবেন যে, মেনোপজ শরীরের প্রতি আপনার নজর দাবি করছে। এমনকি, এ বিষয়ে আপনার ডাক্তারের পরমার্শও নিতে হতে পারে।
কোন বয়সে আপনি মেনোপজের মধ্য দিয়ে যাবেন?
মেনোপজ শুরুর গড় বয়স ৫১। বেশিরভাগ নারীর ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মাঝামাঝি সময়ে অস্থায়ীভাবে পিরিয়ড বন্ধ হওয়া শুরু হয়। তবে, ওভারির (ডিম্বাশয়) কার্যকারিতা এরও অনেক আগে থেকে কমে যাওয়া শুরু করে। অনেকের আবার ৫০ দশকের শেষ অব্দি পর্যন্ত পিরিয়ড হতে দেখা যায়।
পেরিমেনোপজ এবং মেনোপজের মধ্যে পার্থক্য কী?
মেনোপজের ঠিক আগের সময়কালকেই পেরিমেনোপজ বলা হয়। পেরিমেনোপজ সেই অন্তর্বর্তীকালীন সময় যখন আপনার শরীর মেনোপজে প্রবেশ করার জন্য তৈরি হচ্ছে। এর অর্থ আপনার ওভারি থেকে হরমোন উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এ সময়েই হট ফ্লাশের মত মেনোপজের উপসর্গগুলো অনুভত হওয়া শুরু হয়। এ সময় মাসিক অনিয়মিত ভাবে হয়ে থাকে, পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় না।
টানা ১২ মাস সময় ব্যাপী মাসিক বন্ধ থাকলে বলা হয়, আপনি মেনোপজে প্রবেশ করেছেন।
শরীরে ইস্ট্রোজেন কমে যাওয়ার লক্ষন কী?
পঁচাত্তর শতাংশ নারী মেনোপজে হট ফ্লাশ অনুভব করে থাকেন, তাই এটিই মেনোপজের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষন। দিনে রাতে যেকোন সময় এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে৷ এরসাথে থাকতে পারে গা ব্যথা, হাড় ও গিড়ায় গিড়ায় ব্যথা( জয়েন্ট পেইন) যাকে আর্থালজিয়া বলা হয় এবং খিটখিটে মেজাজ (মুড সুইং)। মাঝে মাঝে এটা নির্নয় করা কঠিন হয়ে পড়ে, কেন এমন হচ্ছে, এর পেছনে কোন নিয়ামকটি কাজ করছে৷ হরমোন স্বল্পতা, আপনার জীবনের জটিলতা নাকি বয়সের ভার ( এইজিং প্রসেস)
কখন বুঝবেন আপনার হট ফ্লাশ হচ্ছে?
হট ফ্লাসের সময় আপনার মনে হবে, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। হট ফ্লাশ সাধারণত আপনার শরীরের উর্ধাংশে প্রভাব ফেলে, চামড়ার উপরে লাল আভা পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। যেন আগুনের উল্কার মত তাপ, যার ফলে আপনার ঘাম হবে, বুক ধড়ফড় ( প্যালপিটেশন) করবে, মাথা ঘুরতে পারে বা ঝিমঝিম করবে ( ডিজিনেস)। আবার, হটফ্লাশের পর, আপনি এক ধরনের শীতলতা অনুভব করতে পারেন। প্রতিদিন একবার থেকে কয়েকবার পর্যন্ত হট ফ্লাশ হতে পারে। এবং এটি এক বছর থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
যেসব বিষয় হটফ্লাশকে তীব্রতর করে সেসব বিষয় পরিহার করে কিছুটা উপশম পাওয়া যেতে পারে।
বিষয়গুলো হল:
– অ্যালকোহল অথবা ক্যাফেইন সেবন
– তেল মশলা যুক্ত খাবার
– স্ট্রেস
– উষ্ণ তাপমাত্রায় অবস্থান
স্থুলতা ও ধুমপানও হটফ্লাস তীব্রতার জন্য দায়ী হতে পারে। কিছু টেকনিক অনুসরণ করে কিছুটা উপশম পাওয়া যেতে পারে।
যেমন-
-বাসায় বা অফিসে সবসময় ফ্যানের (পাখা) নিচে থাকা।
– হট ফ্লাশের সময় শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম করা। এর জন্য আপনাকে নিয়মিত এই ব্যায়াম অনুশীলন করে আয়ত্ত করতে হবে।
এতেও কাজ না হলে, জন্মবিরতিকরণ পিল ( যেহেতু জন্মবিরতিকর পিলে হরমোনই থাকে), হরমোন থেরাপী এবং আরও কিছু ঔষধ আপনার উপকারে আসতে পারে। তবে, এর জন্য আপনাকে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
হট ফ্লাশ প্রতিকার :
> তেলমশলা যুক্ত খাবার, ক্যাফেই, অ্যালকোহল ও ধুমপাম পরিহার
> পাতলা, আরামদায়ক, সুতি কাপড় পরিধান
> অফিস কিংবা বাসা, সব সময় ফ্যানের বাতাসে থাকা
> প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন
মেনোপজ হাড়ের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলে?
হাড়ের ক্যালসিয়াম ডেপোজিট করায় ইস্ট্রোজেন হরমোনটির ভূমিকা আছে। তাই, ইস্ট্রোজেন এর উৎপাদন কমে যাওয়ায় হাড়ে ক্যালসিয়াম কমে যায়, ফলে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়, যাকে বলা হয় হাড়ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস। ফলে কোমড়, মেরুদন্ড ও অন্যান্য হাড় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি অনেকগুন বেড়ে যায়।
বেশিরভাগ নারীই তার জীবনের লাস্ট পিরিয়ড বা শেষ মাসিক থেকে প্রথম কয়েক বছর অনেক ত্বরান্বিত হাড়ক্ষয়ের শিকার হন।
হাড় সুরক্ষায় করনীয়:
> ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ
> ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ
> নিয়মিত শরীর চর্চা, বিশেষ করে ওয়েট ট্রেইনিং
> অ্যালকোহল পরিহার বা পরিমানে কমানো
> ধুমপান বর্জন
হাড়ক্ষয় রোধে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়ারও অবকাশ আছে।
মেনোপজের সাথে কি হৃদরোগের কোন সম্পর্ক আছে?
হার্টের সাথে জড়িত কিছু উপসর্গ মেনোপজে দেখা যায়। যেমন- বুক ধড়ফড় ও মাথা ঝিমঝিম করা।
শরীরের ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে গেলে, রক্তনালীর সংকোচন প্রসারন ক্ষমতা কমে যায়, ফলে রক্ত চলাচল ব্যহত হয়।
ওজন নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যসম্মত ও সুষম খাবার গ্রহণ, নিয়মিত শরীর চর্চা, ধুমপান পরিহার হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
মেনোপজের সময় কি আপনার ওজন বৃদ্ধি পাবে?
শরীরে হরমোনের মাত্রা পরিবর্তনের কারনে আপনার ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে৷ তবে, ওজন বৃদ্ধিতে এইজিং প্রসেসেরও ভূমিকা আছে।
সুষম খাবার, নিয়মিতি এক্সারসাইজ ও অন্যন্য স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস আপনাকে ওজন নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করবে । অতিরিক্ত ওজন আপনাকে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য অনেক অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিবে।
ওজন নিয়ন্ত্রন:
> স্বাস্থ্য সম্মত জীবন যাপনে মনোনিবেশ করুন।
> ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ ও শর্করা স্বল্প সুষম খাবার গ্রহন করুন
> সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার এক্সারসাইজ অথবা ৭৫ মিনিট দৌড়ানোর মত তীব্র মাত্রার এক্সারসাইজ করুন।
> আপনার ওয়ার্ক আউট রুটিনে স্ট্রেন্থ এক্সারসাইজ রাখতে ভুলবেন না।
আমিও কি আমার মা, বোন কিংবা বন্ধুর মত একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাব?
উপসর্গগুলোয় একজন নারী থেকে আরেক জনে তারতম্য হতে পারে, এমনকি একই পরিবারের নারীদের ক্ষেত্রেও কমবেশি হতে পারে। ওভারির কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার হার ও বয়স ভেদে অনেক ভিন্নতা দেখা যায়। এটি নির্দেশ করে, প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার ভিন্নতা থাকবে। আপনার মা বা সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুর ক্ষেত্রে যেই ব্যবস্থাপনা কাজ করেছে, সেটি আপনার ক্ষেত্রে নাও করতে পারে৷
আপনার মনে কোন প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। তিনি আপনাকে আপনার উপসর্গগুলো সনাক্ত করে বুঝিয়ে বলতে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করবেন।
হিস্টেরেকটমি করা থাকলে আমি কি জানতে পারব আমার মেনোপজ হয়েছে কি না?
সার্জিক্যাল অপারেশনের মাধ্যমে ইউটেরাস বা জরায়ু কেটে ফেলা দেওয়াকে হিস্টেরেকটমী বলে। হিস্টেরেক্টমী করা থাকলে, হট ফ্লাশ ছাড়া বলার উপায় নেই, আপনার মেনোপজ হয়েছে কি না।
এন্ডোমেট্রিয়াল অ্যাবলেশান করা রোগীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যাদের পিরিয়ডের সময় অতিরিক্ত রক্তস্রাব হয়, তাদের ক্ষেত্রে জরায়ুর লাইনিং বা আবরনী স্যার্জিকালি রিমুভ করে এই চিকিৎসা করা হয়।
উপসর্গ দেখা না গেলে, রক্তপরীক্ষার মাধ্যমে মেনোপজ নির্নয় করা যায়। এটা এই জন্য জরুরী কারন, এর সাথে আপনার হাড়ক্ষয়ের বিষয়টি জড়িত। ইস্ট্রোজেন লেভেল নির্দেশনা দেবে আপনার হাড়ের ঘনত্ব নির্নয় করতে হবে কি না।
হরমোন প্রতিস্থাপন কি মেনোপজ ম্যানেজমেন্টের একটি নিরাপদ অপশন?
হট ফ্লাশ এবং হাড়ের ক্ষয় রোধে এফডিএ (FDA) অনুমোদিত বেশ কিছু হরমোন চিকিৎসা রয়েছে। এ থেকে কতখানি উপকার পাবেন বা কততুকু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে তা আপনার হট ফ্লাশের তীব্রতা, হাড়ক্ষয় ও স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করে। এই থেরাপীগুলো আপনার উপযোগী নাও হতে পারে, তাই যেকোন ঔষধ গ্রহনের আগে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
মেনোপজের উপসর্গ উপশমে কি কোন নন-হরমোনাল ব্যবস্থাপনা আছে?
যেরকমটা আগে বলা হয়েছে, হরমোন থেরাপী আপনার উপযোগী নাও হতে পারে। কিছু মেডিক্যাল কন্ডিশনে হরমোন থেরাপী নিরাপদ নয়। লাইফস্টাইল মডিফিকেশন হরমোন থেরাপী ছাড়াও আপনাকে অনেকখানি উপশম দিতে পারে।
লাইফস্টাইল মডিফিকেশনের মধ্যে আছে:
-ওজন নিয়ন্ত্রণ
-এক্সারসাইজ
-ঘরের তাপমাত্রা কমিয়ে রাখা
-সেসব খাবার পরিহার যা আপনার উপসর্গগুলোকে আরও খারাপ করে তুলে
-পাতলা সুতি কাপড় পরিধান
এছাড়াও ভেষজ চিকিৎসা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, অ্যাকুপাংচার, স্বল্প মাত্রার অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট এবং অন্যান্য কিছু মেডিকেশন উপকারে আসতে পারে।
হাড়ক্ষয় রোধে FDA স্বীকৃত কিছু মেডিকেশনের মধ্যে আছে-
– বিসফসফোনেট
– সিলেক্টিভ ইস্ট্রোজেন রিসিপটর মডুউলেটর
– ক্যালসিটোনিন
– ডেনোজিউমাব
– প্যারাথাইরয়েড হরমোন
– ইস্ট্রোজেন প্রডাক্ট
বাজারে পাওয়া যায় এমন কিছু লুব্রিকেন্ট, ইস্ট্রোজেন ক্রিম আপনারর যোনীপথের শুষ্কতার সমাধানে সাহায্য করতে পারে।
মাথা গেঁথে রাখুন:
মেনোপজ একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। এটি এমন একটি সময় যখন আপনার শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্ট্রেরন হরমোনের মাত্রা কমে যায়। মেনোপজের সাথে সাথে অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ক্ষয়, হৃদরোগ ও অন্যান্য অসুস্থতার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
মেনোপজের উপসর্গ কমাতে আপনাকে সুষম খাদ্য গ্রহনের পাশাপাশি এক্সারসাইজ করে ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে।
পরিস্থিতি আপনার নিয়ন্ত্রনের বাইরে গেলে, অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। মেনোপজে প্রবেশের বয়সসীমায় রেগুলার চেক আপে সময় মেনোপজ বিষয়টি নিয়ে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
ডা. শাফেয়ী আলম তুলতুল: প্রভাষক ( মাইক্রোবায়োলজী), ইস্ট ওয়েস্ট মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা।