November 2, 2024
মুক্তমত

যে যার নিজের ভাষায় স্বচ্ছন্দ্যে কথা বলুক

সাবরিনা শারমিন বাঁধন।। ছোটবেলায় একবার ইশকুল থেকে  শহীদ মিনার নিয়ে যাচ্ছে সকলকে। আমিও বায়না করলাম বাড়িতে শহীদ মিনার যাওয়ার জন্য,  কিন্তু বাবার আপত্তি!  ঠান্ডা, টাইফয়েডের ভয়ভ্রান্তি দেখিয়ে যেতেই দিলনা। পরবর্তীতে একবার একটা নাটকের ছোট্ট একটা পার্ট করার ডাক পেলাম। তখন ইশকুলে বাচ্চাদের প্রেশনা দেবার জন্য বলা হল যারা যারা অংশগ্রহণ করবে সকলকে পাঁচ নম্বর বেশি দেয়া হবে বার্ষিক পরীক্ষায়। এই কথাটা মায়ের কাছে টোপ হিসেবে ফেলে কাজ হল। মা রাজি হলেন, তখন পঞ্চম শ্রেণি।তারপর সেই নাটকে একখানা পুরষ্কার নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

পরবর্তীতে একটু বড় হয়ে (হয়তো ক্লাস নাইনে পড়ি) একুশে ফেব্রুয়ারিতে কোচিং এ অনুষ্ঠান ছিল। একখানা কবিতা আবৃত্তি করলাম “নির্মলেন্দু গুন” এর। সেখানেও প্রথম পুরস্কার নিয়ে বাড়ি ফিরলাম কিন্তু ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা পেরিয়ে যাওয়া কি বকুনি না সহ্য করেছি মায়ের! অথচ একাও নয়, বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছিল আমার বন্ধুর বাবা। সেই বন্ধু আবার ছেলে ছিল, ছেলে বন্ধু হবার ফলাফলও বেশ খারাপই ছিল। কিন্তু কোনদিন শহীদ মিনার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি উচ্চমাধ্যমিক অব্দি। পরে একবার বুবুর একখানা শাড়ি পরে আমার জানের টুকরা কেয়নের কাছে বায়না করলাম বইমেলায় নিয়ে চলো,তখন সদ্য মফস্বলের পাট চুকিয়ে ঢাকা এসেছি। কেয়ন আবার আমার কথা ফেলতে পারেনা!

ওই প্রথম বইমেলা আর শহীদ মিনার দেখা। এখন মনে পড়লো একবার ছোটবেলায় কেয়নের বাড়িতেই ঢাকা এসেছিলাম বেড়াতে, সেবার অনেক রাতে একুশের শেষ প্রহরে গিয়েছিলাম শহীদ মিনার। ফুপার চাকরি সুত্রে বেদীতে উঠতে পেরেছিলাম। কি একটা ফুল দিয়ে দুই-বোন ফিরে এলাম।(কেয়ন আমার ফুপু, বোন বলতে, ওর মেয়ে)।
পরে একবার বাপুর কাছে বায়না করলাম বাবা এবারে শহীদ মিনারে একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে নিয়ে যাবে? বাপু বললেন,আমরা তো প্রতিবছর সম্মান জানাতে যাই, এবারেও যাবো বাপ।তুমিও যাবে।

আমি সাদা খোলের একখানা শাড়ি পরে বাপুর সাথে হাতে ফুল নিয়ে গেলাম শহীদ মিনার।দেখলাম বাপু শহীদ বেদী সালাম করছে চোখ ভরতি জল নিয়ে! আমিও সালাম করলাম দেখলাম আমার চোখও অশ্রুসিক্ত। ওই প্রথম আমার বুঝতে শেখা এই ভাষাটা কেন এতটা আপন!

তারপর শহীদ মিনার আমার প্রিয় জায়গা হয়ে উঠলো, আমার কাছের, ভালোবাসার।

ভাষা মানে মনের কথা প্রকাশের প্রথম মাধ্যম। এই ভাষাটা যে এত আদরের, তা আরও হৃদয়ে অনুভব করলাম পরদেশে এসে। যেখানে অনেক কয়টা ভাষা পথে বেরুলেই শোনা যায়। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশিরভাগ মানুষ হিন্দিভাষী, যা আমার বোধগম্য সামান্য। আমার ক্লাসের দুইজন শিক্ষক যারা বাংলা বলতেই পারেননা। আমিও হিন্দিতে পারদর্শী নই। ইংলিশে সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু তাঁদের সাথে কথা বলতে, কথা বোঝাতে তেমন একটা অসুবিধায় পড়িনি এখনো। সেদিন “ফুড ফেস্টিভ্যাল” এ আমার বাড়ির দাদা গিয়েছিল অতিথি হয়ে।আমার শিক্ষকদের সাথে বাংলায় কথা বলছিল। আমি বললাম, ম্যাম বাংলা বোঝেনা হিন্দিতে কথা বলো। ম্যাম বলে উঠলো, ম্যাম বাংলা বোঝে। তারপর আবার হিন্দিতে দাদাকে বললো- আপনি যা বলেছেন সেটা সব না বুঝলেও আপনার কথার সারমর্ম বুঝেছি।

আমার কি যে আনন্দ হলো!

আমার দেশ, বাংলাদেশেও অনেক ভাষা আছে কিন্তু সেগুলো অনাদরে পরে আছে। সেগুলো প্রয়োগ করতে গেলে নানারকম প্রতিকূলতার শিকার হয় মানুষ।

আজ এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমার দু’টো জিনিস চাওয়া।

সকল বাবা-মাকে বলছি নিজের সন্তানকে নিজের দেশ সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিন। সন্তানকে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধসহ ঐতিহাসিক জায়গায় নিয়ে যান,তাকে দেশের সঠিক ইতিহাস জানতে সাহায্য করুন, তার হাতে বই তুলে দিন। ইংরেজী ভাষা ছাড়া জীবন অচল বটে, ইংরেজী মাধ্যমে সন্তানকে পড়ানোটা জরু বিভিন্ন দিক থেকে, কিন্তু তারপরও সন্তানকে বাংলা সিনেমা দেখান, বই পড়তে দিন। ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা নয় বরং বাংলার পাশাপাশি ইংরেজী শেখান। এই ভাষাটা কি করে আমাদের হল সেটা সন্তানকে জানান। দেখবেন আপনার সন্তান পথ হারাবেনা।

আরেকটা চাওয়া সকল প্রতিকূলতা দূর হয়ে যাক।
যে যার নিজের ভাষায় স্বচ্ছন্দ্যে কথা বলুক। ভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে অনেক সুন্দর সুন্দর এ্যাড হয়েছে আমার দেশ বাংলাদেশে।সেগুলো প্রচার হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিন্তু সেগুলো শুধু এ্যাড নয়, প্রতিদিন মানুষের জীবনে প্রয়োগ হোক এটাই চাওয়া।
ভাষা হোক উন্মুক্ত।

ভাষা হোক সব থেকে গর্বের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *