ধর্ষণের সমাধান কি নৃশংসতায়?
বীথি সপ্তর্ষি।। ধর্ষণ নিয়ে সমাজের বিরাজমান চিন্তাপদ্ধতি ও সমাধানের পথ অত্যন্ত অগভীর। ফলাফল নিরপেক্ষ বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। ধর্ষণ এমন একটা শারীরিক, মানসিক ও মানবিক ক্রিয়া একবার নারী তার মুখোমুখি হলে আজীবন সে অভিজ্ঞতার ক্ষত বয়ে বেড়ায়। ধর্ষণকে তাই শুধুমাত্র বাহ্যিক ক্ষতি, সম্মান-অসম্মানের তাত্ত্বিক ভিত্তি বা নারী-পুরুষের সম্পর্কপ্রণালী দিয়ে বোঝা যাবে না। নিঃসন্দেহে ধর্ষণের সাথে ক্ষমতার চর্চা, পেশীশক্তি, সম্পর্কের শ্রেণিবিভাগ ও নারীর সামাজিক-রাষ্ট্রীয় অবস্থানের যোগসূত্র রয়েছে। কিন্তু এগুলোর কেবল একটি নিয়ামক দিয়ে তা সংজ্ঞায়িত করা স্থূল ব্যাপার হবে।
ধর্ষণের শাস্তি নিয়ে প্রচলিত আলাপগুলোও অত্যন্ত সমস্যাজনক। ধর্ষণ বন্ধের একমাত্র উপায় ধর্ষণ বন্ধ করা। সেটা যদি বন্ধ করতে হয় তাহলে শাস্তি নিয়ে কথা বলাটা অপ্রাসঙ্গিক। যখনই শাস্তি নিয়ে কথা বলা হয়, কোন না কোনভাবে সেটা আরেকটা ধর্ষণের অপেক্ষায় বসে থাকার অনুমোদন দেয়া হয়। ধর্ষণ একটা ঘটলে তারপর শাস্তি নিয়ে কথা বলা প্রাসঙ্গিক। কিন্তু ধর্ষণ বন্ধের আলাপে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সিস্টেম মেরামত না করে, মানুষের চিন্তাপদ্ধতির ওপর ছুরি-কাঁচি না চালালে তো পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে ধর্ষণ কোনভাবেই রোধ করা যাবে না।
ধর্ষণের শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ধর্ষণ নির্মূল- প্রকারান্তরে ভয়ঙ্কর সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি করা। মধ্যযুগে অন্যায়ের মাত্রা বিবেচনা করে হাত কাটা, পা কাটা, লিঙ্গ কর্তন, এমনকি গর্দান নেয়ার চলও ছিল। কিন্তু সময় বদলেছে। যে কোন ধরণের সহিংসতার বিপক্ষে মানুষ সংবেদনশীলতা চর্চার কথা বলছে। সেখানে ধর্ষকের লিঙ্গ-কর্তন আপাত সমাধান মনে হলেও তা দিয়ে ধর্ষণ পরবর্তী সময়ে ওই একই ধর্ষকের দ্বারা আর কোন ধর্ষণ না ঘটার নিশ্চয়তা তৈরি করা ছাড়া পরবর্তী ধর্ষকের জন্য তা কোন ফলাফল বয়ে আনবে না। যে লিঙ্গ হারিয়ে ফেলছে, তার অঙ্গহানি ঘটলেও তার ভাবনার জায়গায় কোন পরিবর্তন আসছে না। এরপর সে তার অবদমন বা বিকৃতি চরিতার্থ করার জন্য মৌখিক হয়রানি শুরু করলে তখন কি তার জিহ্বা কেটে নেয়ার দাবি তোলা হবে? তারপর মস্তক ছিন্নের দাবি?
ধর্ষক তো আর একজন মানুষ নয়, একটি মাত্র লিঙ্গ করে না। এমনকি পুরুষাঙ্গে কোন মগজ যেহেতু নেই, ধরে নেয়া যেতে পারে দোষটা পুরুষাঙ্গের নয়। বরং মস্তিস্কের যে কোষে ‘নারীর কোন স্বতন্ত্র সত্ত্বা নেই’, ‘নারীর নিজের শরীরের ওপর নিজের কোন অধিকার নাই’, ‘নারী অন্যের সিদ্ধান্তে পরিচালিত হবে’, ‘নারী যোনি-স্তন সর্বস্ব প্রাণি’ এবং ‘নারীর কোন মতামত থাকতে পারে না’ শীর্ষক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সমস্যাটা সেখানে। যে চিন্তা মস্তিষ্কপ্রসূত তা প্রতিহত করতে লিঙ্গ-কর্তন কোন বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান নয়।
যাই হোক ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে যারা ধর্ষণ করছে তারা ‘ধর্ষণ’ ধারণা সম্পর্কেই জ্ঞান রাখে না। তারা মনেই করে, নারীর কোন মতামত থাকতে পারে না। তারা মনেই করে পুরুষের শারিরীক চাহিদা মেটানোর জন্য তার একার সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমই সব। তারা মনেই করে শারীরিক সম্পর্ক একপাক্ষিক, পারস্পারিক নয়। যারা এই পারস্পারিক সম্পর্ক-কাঠামোর ধারণা না নিয়েই বড় হয়, বেড়ে ওঠে তাদের কাছে ধর্ষণ কোন অপরাধ বলে গণ্য হবে না সেটাই স্বাভাবিক।
মধুমিতা পাণ্ডে নাম্নী ভারতীয় এক তরুণী ধর্ষকের মনস্তত্ব নিয়ে গবেষণা করার জন্য তিহার জেলে ১০০ জন অভিযুক্ত ধর্ষকের সাক্ষাৎকার নেন। এবং তিনি আশ্চর্য হন যে তারা জানেনই না তারা কেন জেলে আছেন? তাদের কোন কৃতকর্মের ফল এই হাজতবাস? এক ধর্ষক যিনি ৫ বছরের এক মেয়ে শিশুকে ধর্ষণের দায়ে জেলে আছেন, বলে বসলেন ‘হ্যাঁ আমার খারাপ লাগছে, আমি তার জীবন নষ্ট করে দিয়েছি। এখন সে আর কুমারী নয়, কেউই তাকে বিয়ে করবে না। আমি তাকে গ্রহণ করব, জেল থেকে বেরিয়ে এলে আমি তাকে বিয়ে করব।’
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, যারা মনে করে- যে ক্রিয়ায় একপক্ষের কোন ধরণের অংশীদারিত্ব নাই সেখানে ধর্ষণের সামাজিক সংজ্ঞা বিনির্মাণ ও সমাজের সকল সদস্যের মধ্যে তা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া ধর্ষণ বন্ধ হবে না। বর্বর শাস্তি, সহিংস আইন, রাষ্ট্রীয় খুনকে এসবের সমাধান ভাবা তাই অর্বাচীনতার সামিল। যে কোন সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক সমস্যাকে আইন দ্বারা সমাধানের চেষ্টা করা ঐতিহাসিকভাবেই ভুল সিদ্ধান্ত। বরং সেই সংস্কৃতির বিপরীতে সুস্থ-সংবেদনশীল শক্তিশালী সংস্কৃতির প্রচলন ঘটানো ফলপ্রসূ হতে পারে। সমাজের যে কোন অসংগতি নিয়ে যারা সোচ্চার, বিদ্যমান নিয়ম-কানুন নিয়ে যারা সংশয়ে থাকেন, রাষ্ট্রীয় ও আরোপিত চিরন্তন প্রথাকে যারা বাতিল করেন তাদের দ্বারা নিজেদের উপকারী ঐতিহ্য অক্ষুন্ন রেখে মানবিক সংস্কৃতির ঢেউ সৃষ্টি করা তো এমন কিছু কঠিন কাজ হবার কথা নয়। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা আর বিষয়ভিত্তিক স্বচ্ছ ধারণা।
ধর্ষক হয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করে না। পরিবার, প্রতিবেশ ও বেড়ে ওঠা তার অভিজ্ঞতা ও চর্চায় বাধা-বিঘ্নহীনভাবে যে ধারণার জন্ম ও কালান্তরে বিকশিত হয় তার সার্বিক ফলাফলই ধর্ষণের মনস্তাত্ত্বিক গ্রাউন্ড রচনা করে বলে ধরে নেয়া যায়। এর সাথে অর্থ, শ্রেণি, পেশা বা অন্যান্য সেকেন্ডারি ফ্যাক্টরের কোন সম্পর্ক আসলে নেই। তাই ‘পুলিশ হয়ে ধর্ষণ করল’, ‘শিক্ষক হয়ে এমন ঘৃণ্য কাজ করল’, ‘ডাক্তার হয়ে কীভাবে পারল’ বলে বিস্ময় প্রকাশ করার কিছু নেই। তার পাঠ্যপুস্তকের অক্ষর তাকে পুলিশ বা শিক্ষক বা ডাক্তার বা সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তুলেছে। তাকে পেশাগত কাজের যোগ্য করে তুলেছে। কিন্তু অন্যান্য মানুষ তথা নারীর সাথে সহাবস্থানে সমাজে বসবাস সম্পর্কিত কোন জ্ঞান দেয়নি। সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় গবেষণা করে দেখিয়েছেন কীভাবে জমজ সহোদর বনে থাকলে বন্য , সভ্য মানুষের পৃথিবীতে থাকলে সভ্য হয়। সেসব আর নতুন করে বলবার কিছু নেই। মানুষকে তাই সমাজ বিচ্ছিন্ন খুনী-ধর্ষক হিসেবে দেখলে অনেক সমস্যারই গভীরে যাওয়া সম্ভব হবে না।
বীথি সপ্তর্ষি: লেখক ও সাংবাদিক
bithysoptorshi@gmail.com
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]