“মাত্র একটা থাপ্পড়!”
রাজনীন ফারজানা।।
– স্বামীর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য আপনাকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে।
– কিন্তু আমি যাবো না।
– সমস্যা কী? শ্বশুরবাড়ির লোকজন?
– না।
– তবে কী স্বামীর পরকীয়া?
– না।
– আপনি নিজে অন্য সম্পর্কে আছেন?
– না।
– তবে কী শুধুই একটা থাপ্পড়!
– হ্যাঁ, একটা মাত্র চড়! কিন্তু সেটা সে মারতে পারে না।
সাদা একটা সালোয়ার কামিজ পরে সিধেসাদা চেহারার তাপসি পান্নুর সঙ্গে স্মার্ট চেহারার উকিলের কথোপকথন। শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) মুক্তি পাওয়া হিন্দি সিনেমা থাপ্পড়ের ট্রেলারের প্রথম পঁচিশ সেকেন্ডের দৃশ্য এটি।
ট্রেলারে এরপরই হাসিখুশি সংসারের দৃশ্য। এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙছে স্বামীর আলিঙ্গনে ঘুমিয়ে থাকা অমৃতার। পরম যত্নে চা বানাচ্ছে, স্বামীর গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছে ফাইলপত্র। ব্যস্তভাবে গাড়িতে ঢুকতে যাওয়া স্বামীর মুখে অনুনয় করে খাবার তুলে দিচ্ছে প্রেমময়ী স্ত্রী। শ্বাশুড়ির যত্ন করছে। সুন্দর তরুণ দম্পতি। স্বাভাবিক (!) রোমান্টিক দৃশ্যপট। কিন্তু দর্শকের মনে ঘুরতে থাকে উকিলের বলা সেই কথাটি ‘সো, জাস্ট এ স্ল্যাপ দ্যান।’
প্রশ্ন জাগে, এই হাসিখুশি সংসারে কী এমন হয়েছিল যে অমৃতাকে থাপ্পড় খেতে হয়? খুব কি অচেনা দৃশ্য। ভারতীয় উপমহাদেশের এই আমাদের প্রায় সবার মনে কি এমনই দুই একটা স্মৃতি নাই? নিজের সঙ্গে ঘটেনি কখনো? নিজের পরিবারে অথবা পরিচিত মহলেও কি দেখিনি এমন দৃশ্য?
বাংলা নাটক আর সিনেমায় তো প্রেমিকা বা স্ত্রীকে থাপ্পড় মেরে তাদের ‘শয়তানি’ ঘুচিয়ে দেওয়ার নজির বহু আছে। এবং চড় খেয়ে নায়িকার বোধোদয় হয় যে সে কত খারাপ! তাই তাকে খারাপ পথ থেকে সরিয়ে আনার কৃতিত্ব স্বরূপ ‘সাক্ষাৎ দেবতা’ স্বামীর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে কান্নাকাটি করে ক্ষমা চাওয়ার অনেক দৃশ্য দেখেছি আমরা। অর্থাৎ যুগে যুগে ঘুরে ফিরে বলা হয়েছে নারীর অভিভাবক পুরুষ। তাই সে সম্পর্কের দোহাই দিয়ে থাপ্পড় মেরে শাসন করার অধিকার রাখে।
তাপসি পান্নুর থাপ্পড় যেন সমাজের সেই চিন্তার গালে সজোরে এক পাল্টা থাপ্পড়। সিনেমার ট্রেলারের শুরুতেই তাই অধোমুখে বসে থাকা নায়িকার কণ্ঠে দৃঢ় উচ্চারণ- ‘জাস্ট এ স্ল্যাপ। পার নেহি মার সাকতা’
আমাদের ভাবায়। আসলেই তো। কেন মারবে? কে দিল পুরুষকে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার অধিকার?
আসুন ফিরে যাই অমৃতার জীবনে। ভরা পার্টির মধ্যখানে স্বামীর হাতে সজোরে চড় খেয়ে শুধু মুখটাই নয়, অমৃতার জীবনটাই যেন ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। পরের দৃশ্যেই দেখা যায় কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে জোরে জোরে বসার ঘরের আসবাবপত্র সরাচ্ছে সে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে মুখে, তারপর সেই ঘামের ফোটা আওয়াজ করে ঝরে পড়ছে হাতের চুড়িতে। বিবাহিত নারীর এই কি তবে জীবন! শাড়ি-চুড়িতে সুসজ্জিত নারী। সঙ্গে চিরচেনা অবমাননা! পরিচালক অনুভব সিনহা ভারতীয় সংস্কৃতির মূলে আঘাত করেছেন একটি থাপ্পড় দিয়ে।
রাজধানী দিল্লির সম্পন্ন ঘরের মেয়ে অমৃতা যার স্বপ্ন ছিল ‘পারফেক্ট’ গৃহবধূ হওয়া। বিয়ের আগে ক্ল্যাসিকাল নাচ করলেও সংসারের মায়ায় তা ছেড়ে দেয়। এদিকে অমৃতার স্বামী বিক্রম কিন্তু ঠিক তথাকথিত সিনেমার ভিলেন না। তবে নিজের অজান্তেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সুবিধাভোগী। তাদের বাড়ির নেমপ্লেটে শুধুই বিক্রমের নাম। অমৃতা এবং তার শ্বাশুড়ি যেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। তাদের দায় ‘পুরুষ’ বিক্রমের জীবনের আরাম আয়েশ নিশ্চিত করা।
বিক্রম শিক্ষিত, ভালো চাকুরে, ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত আধুনিক ভারতীয় তরুণ। কিন্তু অফিসের অশান্তির ঝাল ঠিকই স্ত্রীর উপরেই ঝাড়ে। স্ত্রীকে ভালোবাসা বিক্রম কেরিয়ারের নেশায় যেন শয়তানে পরিণত হয়। জমজমাট পার্টির মধ্যে স্ত্রীকে চড় মারে সে।
এরপরই দেখা যায় সমাজের সেই চিরাচরিত চিত্র। মা, শ্বাশুড়িসহ বাকি সবাই চাপ দেয় সংসারটা টিকিয়ে রাখতে। একটা থাপ্পড় নিয়ে এত ‘রিয়্যাক্ট’ করার কী আছে!
স্বামীর সঙ্গে থাকতে বাধ্য করা হয় অমৃতাকে। কিন্তু সেদিনের সেই চড় ভেতর থেকে বদলে দেয় তাকে। রাগ, ক্ষোভ, কষ্ট, অভিমান মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়– জন্ম হয় অন্য এক অমৃতার। আমরা দেখি সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে স্বামীর পাশে শুয়ে আছে নির্বাক অমৃতা। এসময় ভাগ্যক্রমে পাশে পেয়ে যায় বাবাকে। তারপরই ট্রেলারে উকিলের কাছে যাওয়ার দৃশ্য দেখি আমরা। শুরু হয় সিনেমার আসল ক্লাইম্যাক্স।
একে একে দৃশ্যপটে আসে বিভিন্ন পর্যায়ের নারীর বিবাহিত জীবনের অসুখী চিত্র। প্রতিবেশি সিঙ্গেল প্যারেণ্ট শিবানি, আইনজীবী নেত্রা জয়সিংহ- সবার জীবনের আলাদা আলাদা গল্প বুনেছেন পরিচালক। আর এভাবেই ছোটখাটো গার্হস্থ্য হিংসা যা আমরা গুরুত্ব দেই না, সেটিকেই স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন। ঠিক যেমন আতশকাচে দেখা ছোট্ট একটা ক্ষতের মধ্যে লক্ষকোটি জীবাণু।
অনুভব সিনহা পরিচালিত এই চলচ্চিত্রের মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তাপসি পান্নু। শিবানি চরিত্রে দিয়া মির্জা, বিক্রম চরিত্রে পাভেল, উকিলের চরিত্রে মায়া সারাও ছাড়াও আছেন তানভি আজমি, রত্মা পাঠক শাহ্, রাম কাপুর, কুমুদ মিশ্র ও অন্যান্য। সমাজের অনুচ্চারিত এই বিষয়টাকে তুলে আনায় মুক্তির আগে থেকেই আলোচনায় এসেছে এই সিনেমা। ২৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তির পর সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে সমালোচক- সব মহলেই দারুণ প্রশংসা কুড়োতে শুরু করেছে।
রাজনীন ফারজানা: সাংবাদিক ও লেখক