পুরুষ হিসেবে যে ভুলগুলো স্বীকার করতে চাই…
মাশায়েখ হাসান।। কিছু জিনিস কোন না কোনভাবে এই সমাজ থেকেই শিখেছি। ভুল শিখেছি। এবং এই সমাজ থেকেই শিখেছি। আর সেই ভুল শেখা থেকেই নিজের নানা আচরণও গড়ে তুলেছি।
যেমন:
১. মেয়েরা মিনমিন করে কথা বলে। আর সেভাবে কথা বলা ছেলেদের মানায় না। নম্রতা থেকে শুরু করে দাসত্ব পর্যন্ত সকল নরম স্বভাবের আদর্শ প্রতিফলক মেয়েরা।
২. “তুমি মেয়েদের মত করে কথা বলো” ধরণের মন্তব্যের মাধ্যমে একটা সমগ্র লিঙ্গকে পরোক্ষভাবে নিচে নামানোর বিরুদ্ধে জবাব হিসেবে আমি নিজের আচরণকে পাল্টানো সহজ মনে করেছি। নিজেকে “ছেলেদের মত পুরুষালি” বানানোকে দায়িত্ব মনে করেছি।
৩. কথার মাঝে বিনয়ের প্রতিফলনে নিজের অজান্তেই হাসিমুখে কথা বলতাম। “নারীর মত দুর্বলতা ভেবে” নিজের অজান্তেই আবার জোর করে হাসি চেপে, গলার ভেতর থেকে গাঢ় শব্দ করে কথা বলতে শিখেছি আমি। কারণ, পুরুষের ওই নম্রতা মানায় না।
৪. মেয়েদের পিরিওড এর মত সাধারণ বিষয় নিয়ে কৌতুক করে বন্ধুমহলে নিজের স্থান ঠিক রাখতে হাসতে শিখেছি। কৌতুক করতেও শিখেছি। কোন না কোন পাত্রের ঘাড়ে ঝুলতেই যার জন্ম, তাকে কৌতুকের পাত্র বানানোই যায়।
৫. পুরুষের থেকে আলাদা অঙ্গের অধিকারী হওয়ার জন্য মেয়েদের প্রত্যেকটি চালচলনকে সেক্সুয়ালাইজ করাই যায়। তাদের অস্তিত্বই যেখানে পুরুষকে সুখি ও খুশি করার জন্য, তাই সেখানে কোনো কিছু আবরণে না থাকলেই আমার সুখ এবং পুরুষজাতির সুখ। আর হ্যাঁ, সেগুলো নিয়েও কৌতুক করা বেশ সাধারণ এবং সেক্সিস্ট জোক ক্র্যাক করা বেশ মজার।
৬. ভবিষ্যতে “বউ এর মত মেয়ে” পাবো বলে একটা সুন্দর ধীর-স্থির স্বর্গের অপ্সরীর প্রত্যাশা করাটা বেশ স্বাভাবিক। পুরুষের স্বপ্নে তো সেই মৃদু ছন্দে হাঁটা মেয়কেই দেখা যায়; যে হাঁটবে শুধু তারই সামনে। অন্য কারও চোখের সুখের বস্তু হতে সে রাজি না।
৭. মেয়েদের জন্য চাকরি করা একটা সৌখিন স্বপ্ন। স্বামীকে সুখ দেয়ার জন্য এবং সন্তান পালন এর জন্য ঘুরে ফিরে মেয়েকেই চাকরি ছাড়তে হবে, কারণ মেয়ে মানুষ ঘরে থাকার জিনিস; বাইরে না।
৮. একটা মেয়ের একদম ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষ হিসেবে খুব বেশি মূল্য নেই। তার মূল্য তখনই আসবে যখন তার পাশে থাকবে তার স্বামী এবং তাকে পূর্ণতা দান করবে তার সন্তান। শুধু একটা মানুষ হিসেবে নারী মূল্যহীন (আর সমাজ জোর করে সেটাকে ‘অমূল্য’ বলতে শেখায়)
৯. নায়িকাকে সবসময় নায়ক বাঁচাতে আসলেও একটা ভঙ্গুর সংসারের খাম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারীরই দায়িত্ব। কারণ “ডিভোর্স কখনই সমাধান না”, কিন্তু একটা বিশ্রী সম্পর্কে আজীবন লেগে থাকা অবশ্যই সমাধান না হলেও মহাস্বর্গীয় বীরত্ব।
১০. নারী-পুরুষ কখনোই এক না। কারণ নারীর জীবনে প্রেগনেন্সি আসতে পারে, পিরিওড আসেই; তাই নারীরা দুর্বল। হয়তবা এই দুটো ঘটনার কারণে তাদের বুদ্ধিমত্তা কোনোভাবে কমে যায় এবং সারা জীবনের মত শারীরিক শক্তিও পুরুষের চেয়ে নিচে নেমে যায়, তাই পুরুষ ছাড়া তার জীবন অচল।
উপযুক্ত সকল প্রাপ্ত শিক্ষা আজ ত্যাজ্য করলাম। যদি এগুলোর একটাকেও কারও কাছে সুশিক্ষা মনে হয় এবং যদি একবারও ভেবে থাকেন যে “নিজের মা/বোন/বউ এইরকম হইলে তখন ঠ্যালা বুঝবা”, তাদের বলে রাখি; আপনি সমান আমি না।
ধন্যবাদ।
মাশায়েখ হাসান: শিক্ষার্থী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]
আরও পড়ুন- কীভাবে আমার ছেলেকে ‘পুরুষ’ নয়, মানুষ করে গড়ছি!
প্রেম, যৌনতা ও শরীর নিয়ে ছেলের প্রতি মায়ের চিঠি