November 2, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

নারীর বেদনা ওরা জানে না!

শবনম দীবা।। পৃথিবীর প্রত্যেক নারী অনন্য সুন্দর। শেষ বিকেলের আলোয় নারীকে কেমন আরো অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। নাহ,  ‘কনে দেখা আলো’ নয়। কেননা, কনে হওয়াটাই নারীর পরিণতি নয়। একটা ঐচ্ছিক অংশ মাত্র। সমাজ, পরিবারের চাপে পড়ে নয়, যদি মন থেকে প্রয়োজন নয়, ইচ্ছা অনুভব করে, সে অংশের জীবনটি যাপন করুক। নারীর পরিণতি নিজের ইচ্ছেমত এক অফুরান উচ্চ জীবনানন্দে বাঁচা, আসলে প্রতিটা মানুষের এভাবেই বাঁচা উচিত। কিন্তু আমরা কে কতখানি বাঁচি নিজের মতো, নিজের জন্য!

অন্যের বাঁচাকেই নিজের বাঁচা বলে ভেবে বাঁচি অসংখ্য জন।  এদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। নিজেকে সামনে দাঁড় করিয়ে যে প্রশ্নই করতে হয়, আমাদের বোধের সীমানায় আসে না। কখনো মনে হয় একটা বয়সে বাঁধতে চাই। আবার একটা বয়সে এত বেশি জাগতিক চাপ এসে পড়ে, সব ভুলে নিজের মধ্যে ডুবে থাকতে চাই। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই।

বাঙ্গালী নারীর জীবন একটা ছকে বাঁধা। আশৈশব শাসন, বারণ, ঘোরতর নিয়মবাঁধা জীবন ক্রমশ আমাদেন নিরন্তর বাঁধনকেই পরিণতি মনে করতে বাধ্য করায়। যেই নারী একটু নিজের মধ্যে ডুবে থাকতে চায়; নিজেকে নিয়ে ভাবতে চায়; নিজেকে সাজায়; নিজের আলাদা যত্ন করতে শুরু করে; অনেক সময় গলা খুলে গান গাইলে; কখনো আপন মনে নেচে উঠলে; নিজেকে প্রশ্ন করে করে উত্তর পেতে শুরু করে অমনি চারপাশটা তাকে সন্দেহ করতে শুরু করে।

নারীকে কেউ বিশ্বাসও করে না। কারণ পিতৃতন্ত্র ভাবতে অভ্যস্ত নারী দুর্বল এবং সকলের তরে সেবা প্রদানে প্রস্তুত। নারীর নিজেকে নিয়ে ভাবনা যেন সংসারে নিষিদ্ধ। ধরুন, আপনি বহুদিন ধরে ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন, ভয়ঙ্কর ক্লান্তিময় একটা জীবন যাপন নয় আর, একটা বয়সে আপনি চেনা মানুষের পরিধি ছেড়ে দূরে কোথাও একটা চলে যাবেন; যেখানে আপনার সখ্যতা থাকবে শুধু পাঠাভ্যাসে; প্রিয় সঙ্গী সাথী পশুপাখির মায়াময় আলিঙ্গনে আর শিশুর বাৎসল্যে। দেখবেন আপনার আশপাশটা আপনাকে ঘোরতর সন্দেহ করা শুরু করেছে। আপনি যাকে কাছের মানুষ বলে ভাবেন, শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য এমনকি আপনার মা-ও আপনাকে সন্দেহ করলে সেটি অস্বাভাবিক কিছু হবে না। কারণ সবগুলো চোখ আসলে পুরুষতন্ত্রের গড়া। সেই তন্ত্র নারীকে কেবল সন্দেহ করতে শেখায়। নারীকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে শেখায়। নারীকে অর্ধেক ভাবতে শেখায়। আপনা থেকেই তাদের মনে এই ভাবনাগুলো ভর করে।

এই একটি উপলব্ধিকৃত সত্যই আপনাকে পাহাড়ের মতো সুকঠিন, অটল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। হ্যাঁ ভালোবাসুন অবারিত তবে আত্ম-সম্মান বজায় রেখে। ভালোবাসা আসলে উন্মুক্ত অনুভূতি। যদিও  মর্ত্যে মায়া ভালোবাসার আরেক নাম নিদারুণ দায়িত্ব। সংসারে থাকলে দায়িত্ব পালন করে যান, লোকে আপনার ওপর খুশি হবে না, তবুও করে যান যতদিন আছেন। শুধু  আপনি কী করছেন এ ব্যাপারে নিজের কাছে স্বচ্ছ থাকুন। যদি আপনি জাগতিক প্রেমের মায়া, বস্তুগত মোহ ছাড়তে পারেন, বুঝবেন আপনি নির্বাণ লাভের পথে এগিয়ে চলেছেন। সম্পর্কগুলো থেকে প্রত্যাশা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনুন। এটাও কিন্তু এক ধরনের আত্মিক ক্ষমতায়ন। নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের বন্ধনে নিজেই বাঁধুন। ওরা যে নারীর বেদন জানে না, তাই ওদের সাথে আপনার ঠিক বন্ধুতাও হয়ে ওঠে না। ওই যে বলছিলাম, শেষ বিকেলের আলোয় নারীকে আরো সুন্দর দেখায়, ওই আলোও কিন্তু নারীর বন্ধু হয় না। দিনের শেষভাগে নারীর মায়ামুখে সৌন্দর্যের সর্বোচ্চ সৌকর্য ছড়িয়ে হুড়মুড়িয়ে সন্ধ্যার পথে মিলিয়ে যায়।

পৃথিবীর সব নারীকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা। আসুন, আগে আত্মিকভাবে ক্ষমতায়িত হই। বাকিটা আপনা আপনিই হয়ে যাবে।

শবনম দীবা: উন্নয়নকর্মী

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]