November 2, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

নারী দিবস কি শো অফ?

সোনিয়া সরকার জয়া।। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ন্যায্য দাবি অর্জনের জন্য একদিন নারী দিবস পালন করার ফলে বাকি ৩৬৪ দিন অদৃশ্যভাবে পুরুষদিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়ে যাচ্ছে কিনা, তার যৌক্তিকতা নিয়ে ইতিবাচক বিতর্কের অবকাশ আছে। এদেশে বাবা বা স্বামীর হাত ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নারীদের দিয়ে যদি কেউ বিচার করে বসে যে দেশ নারী ক্ষমতায়নে সফল, তাহলে তারা পরিষ্কারভাবে বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আবার একজন উপার্জনক্ষম নারীকে দেখেই যদি কেউ আশ্বস্ত হন যে আয় করা নারী মানেই স্বাধীন তাহলে তারও চোখে টিনের চশমা পরানো আছে৷

যে নারীর নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার ক্ষমতা নেই, যার অর্জিত আয়ের অর্থ শ্বশুর ও বাবার বাড়িতে সমভাবে বন্টনের অধিকার থাকেনা, যার আয়ের কোনো অংশই সংসারে ব্যয় হয়না বা সবটুকু আয়ই অন্যের পকেটে রেখে খরচের অনুমতি নিয়ে চলতে হয়; সে নারী যতই উচ্চপদে বসে নিজেকে সর্বেসর্বা ভেবে থাকুক তার সবটাই অর্থহীন।

এই মহাদেশে হাজার বছরের নারী নিপীড়ন, সতীদাহ, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, কন্যাভ্রুণ বা শিশু হত্যা, কন্যাসন্তান জীবন্ত দাফন, সতীত্ব ও বিধবা রীতির কুৎসিত প্রথাগুলো ভেঙে মেয়েদের সমতা অর্জন, শিক্ষাগত যোগ্যতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক ও মানসিক পরনির্ভরশীলতা ঘুচিয়ে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা থেকে ভোটাধিকার অর্জন, সম কর্মপরিবেশ, বেতন, সুবিধা ও আইন প্রণয়নের জন্য প্রায় দুই শতাব্দী আগে থেকে শুরু হয়েছে টুকরো টুকরো প্রতিবাদ। আর যখন গত শতকে এসে নারী আন্দোলন বৃহদাকার রূপ নিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের পূর্ণতা পেল, তখন এই দিবস বা এর নেপথ্যের সুবিধা ভোগ করে বেড়ে উঠা বর্তমান জেনারেশনের কেউই এই একটি দিবসের অবদান হেলায় অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু এই এক নারী দিবস বলেই যখন আজকের দিনে ধর্ষণ আর পারিবারিক সংঘর্ষ বন্ধ থাকে না, বর্ডারে হাইরেটে মেয়েশিশু পাচার হয়, কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমান বেতন ও অগ্রাধিকার পাওয়া যায় না, যখন বছরের মাত্র প্রথম দুইমাসে ধর্ষণ সংখ্যা একশ পার হয়, যৌতুক বা কন্যা জন্ম দেয়াকে অপরাধ বিবেচনায় ঘরের বউকে নির্যাতন করা হয়, কর্মক্ষম না হওয়া মাকে অভাবের তাড়নায় নিজ সন্তানকে হত্যা করতে হয়, তখন বোঝা যায় বাংলাদেশের মত তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশে নারীদিবসের অবদান কতটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

নারী দিবস এখানে একটি প্রতীক মাত্র। যখন প্রতিদিনই মেয়েদের পদে পদে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়ায়ে লিপ্ত হতে হয়, বেঁচে থাকতে হয় ডোমেস্টিক ও ফ্যামিলি ভায়োলেন্স থেকে আউটসাইড আউট্রেজ আর ক্রুয়েলটিকে চ্যালেঞ্জ করে, তখন কেন নারীবাদ চর্চা আর একদিনে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রতিদিন নারীদিবস, আন্দোলন, বাকস্বাধীনতা, প্রতিবাদের প্রয়োজনীয়তা এতটা তীব্র, তা উপলব্ধি করা যায়। যতদিন বৈশ্বিক অর্থনীতির তৃতীয় স্তরে থেকেও উপমহাদেশের মেয়েদের কর্মক্ষম হওয়ার পথে বাধা আসবে, পুঁজিবাদী ক্ষমতায়নে নারীদেহের সস্তা পণ্যায়ন হবে, ঘরের বাবা/বর/ছেলে এমনকি ছোটভাইটিও বন্ধুর বদলে শাষকের ভূমিকায় থাকবে, নারী খাদ্য  তাই ঢেকে রাখার পরামর্শ বা নারী মাংসপিণ্ড ভেবে ধর্ষণে সুখ খোঁজা হবে, মানুষ পরিচয়ে বাদ দিয়ে শুধু মা, বোনের জাতের দোহাই দিয়ে নারীকে আলগা সম্মান প্রদর্শন চলবে, ছেলেবন্ধুর সাথে স্বাভাবিক চলাফেরাকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে নেয়া হবে বা ছেলেবন্ধুই মেয়েবন্ধুকে এভেইলেবল ভেবে দলবেঁধে হায়েনার মত ঝাপিয়ে পড়বে, নিজ যোগ্যতায় প্রোমোশন পাওয়াকে বসের সাথে মধুর সম্পর্কের প্রাপ্ত সুবিধা বলে চালিয়ে দেয়া হবে, নারীর স্বাভাবিক মাতৃত্ব তার ব্যক্তিত্ব ও ক্যারিয়ার দমনের প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে, বিয়ের ৯০% খরচ ও উপঢৌকন নামে যৌতুকের বোঝা মেয়ের পরিবারে চাপানো হবে, মাথায় ছড়ি ঘোরানো পিতৃ ও পুরুষতন্ত্র সমৃদ্ধ ধর্মীয় অনুশাসন নামের অধিকাংশ মানসিক বৈকল্য নির্দ্বিধায় চলবে অর্থাৎ মানুষ বা পুরুষ বলে নয়; শুধু নারী হয়ে জন্মানোকে দায় বানিয়ে যতদিন এখানে দাবিয়ে রাখার একপেশে অনিয়মগুলো সংস্কৃতি বলে মানিয়ে নিতে বলা হবে;  ততদিন এই জনপদে আপত্তি থাকা সত্ত্বেও নারীদিবস পালন বা এতকালের সংগ্রাম থেকে আসন্ন একটা বিপ্লবের গুরুত্ব মেনে না নেয়ার ধৃষ্টতা প্রশ্নাতীত বলে বিবেচিত হবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]