November 2, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ৩

তবে কি তনুরা ফিরছে!

জায়েদ বিন আলী সুজন।।

কাল অবধি কথাটা কানাঘুষা পর্যায়ে ছিল। ফিসফিস করে নিতান্ত বন্ধুবান্ধব বা কাছের মানুষজনের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। এ এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে সবাই যে ব্যাপারটা বিশ্বাস করেছিল, তাও নয়। বরং বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলছিল। জ্বলন্ত সিগারেটে ফুঁক দিয়ে ‘যাহ্! এমন আবার হয় নাকি?’- বলে উড়িয়ে দেয়া কিংবা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ‘অসম্ভব’ বলে প্রমাণ করা ব্যক্তিদের দল ভারি ছিল। অথচ আজ সকাল থেকে নানাজনের মুখে বিষয়টি চাউর হতে শুরু করেছে। কিছু মানুষের কণ্ঠ এমন দৃঢ় যে এটিকে হালকাভাবে নেয়া যাচ্ছে না। যারা ভূত-প্রেতে বিশ্বাসী, তারা কাল অবধি জিন-ভূতেই সমাধান খুঁজেছেন। সেই তারাও আজ ঢোক গিলে স্বীকার করে ফেলেছেন বা করতে চলেছেন। এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া গেলেও এটা মানতে হচ্ছে, এ দুই দিনে এলাকার অনেকেই তনুকে দেখেছে। তনু কি তবে সত্যিই ফিরে এসেছে?

আরেকটু খোলাসা করা যাক। কাল দুপুরে পুকুরঘাটে আরিফা প্রথম তনুকে গোসল করতে দেখে। সে চোখের ভ্রম কিনা নিশ্চিত হতে গাছের আড়াল থেকে দীর্ঘক্ষণ পর্যবেক্ষণ করেছে। শেষমেশ নিশ্চিত হয়েছে- না, ভুল কিছু দেখছে না, এটা তনু ছাড়া আর কেউ নয়। গোসল করার সময় গুনগুনিয়ে গান করতেও শুনেছে- অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান যেন ভুলে যেও না…। আরিফা কী করবে বুঝতে পারে না। ব্যাপারটা কি সবাইকে জানানো উচিত হবে? তার মুখের কথা সবাই বিশ্বাস করবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। তারচেয়ে ভালো আরও দু-চারজনকে ডেকে এনে দেখানো। নিজের চোখে দেখার পর নিশ্চয় কেউ অবিশ্বাস করবে না। আরিফা যে বাড়িতে কাজ করে, সে বাড়ির রেহানা তনুর বান্ধবী ছিল। দু’জনে একই স্কুলে পড়ত। কলেজে উঠে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলাদা হলেও পরস্পরের মধ্যে সখ্য ছিল। অনেকদিন দু’জনকে পুকুরঘাটে বসে গল্প করতে দেখেছে। গল্পের মধ্যে মজার কোনো ব্যাপার এলে হাসতে হাসতে একজন অন্যজনের ওপর গড়িয়ে পড়ত। আরিফার দেখে খুব ভালো লাগত। ইচ্ছা করত ওদের সঙ্গে গল্পে যোগ দিতে। সে সুযোগ কখনও হয়নি। তনু ফিরে এলে এ ইচ্ছাটার কথা বলবে। তার আগে রেহানাকে বিষয়টা জানাতে হবে।

আরিফার কথা বিশ্বাস করার মতো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পায়নি রেহানা। সে গভীর মনোযোগ দিয়ে গল্পের বই পড়ছিল। কাহিনী জমে উঠেছে। নায়ক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। সে সময় এমন আজগুবি কথা শুনলে মেজাজ বিগড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। আরিফার মাথায় আগে থেকেই একটু সমস্যা আছে বলে তার ধারণা। তেঁতুলগাছের মগডালে ভূত দেখার মতো গল্প সে প্রায়ই ফাঁদে। রেহানা বানানো গল্পগুলো বলার ভঙ্গী দেখলেই ধরে ফেলে। তবে পুকুরঘাটে তনুকে দেখার গল্পটা বলার সময় চোখ-মুখে আটপৌরে ভাব ছিল না। বরং গুরুত্ব দিয়েই কথাগুলো বলেছিল। সে কি গিয়ে একবার দেখে আসবে আসলেই তেমন কিছু ঘটেছে কিনা! যদি সত্যিই তনুকে সেখানে দেখতে পায়! আর কিছু ভাবতে পারে না রেহানা। পা বাড়ায় পুকুরঘাটের দিকে।

রেহানা পৌঁছানোর আগেই পুকুরের চারপাশে মানুষের জটলা তৈরি হয়েছে। কুসংবাদ বাতাসের আগে যায়। এটাকে কুসংবাদের খাতায় ফেলা যাবে না। তনু যদি সত্যিই ফিরে আসে তবে সেটা অভূতপূর্ব ব্যাপার হবে। আপাতত না দেখা পর্যন্ত রেহানা বিশ্বাস করতে পারছে না। মানুষের ভিড় এখন আরিফাসহ আরও যারা তনুকে দেখেছে বলে দাবি করছে তাদের কেন্দ্র করে বাড়ছে। মুরুব্বিরা মসজিদে মিলাদ পড়ানোর কথা বলছেন। মৃত মানুষকে জীবিত দেখা ভালো লক্ষণ নয়। বাতাসে দোষ ঘুরে বেড়ায়। এ দোষ কাটাতে নানারকম মানত করতে হয়। পীর-ফকিরের অনুসারীরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন মানত করে ফেলেছেন। কবিরাজ বাবা গ্রামের সবাইকে একটা করে তাবিজ ঝুলানোর পরামর্শ দিয়েছেন। রেহানা ভাবছে ভিন্ন কথা। তনু যদি সত্যিই ফিরে আসে সে কি আগের মতোই আচরণ করবে? তাকে চিনতে পারবে? সব ঘটনা বলবে তার কাছে?

-কে? কে ওখানে? তনু নাকি?

কোনো সাড়া নেই।

সন্ধ্যার খানিক পর কলতলার দিকে যেতেই তনুর মা আনোয়ারা বেগমের চোখে পড়ে দৃশ্যটা। বালতির পানি দিয়ে কেউ একজন হাত-মুখ ধুচ্ছে। অবিকল তার মেয়ে সোহাগীর মতো। তবে সত্যিই কি লোকমুখে যা শুনছে সেটিই সত্যি! ফিরে এসেছে তাদের সোহাগী, আদরের তনু! তনুর জন্য কী আহাজারিই না করেছেন এ কয়দিন! সেই মেয়ে ফিরে এলে তার আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কথা। অথচ বাস্তবে তেমন হচ্ছে না। উল্টো কেমন ভয় ভয় করছে। মনটা এখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক অংশ চাইছে তনু যেন সত্যিই ফিরে আসে। আরেকভাগ চাইছে তনুর ফিরে আসার বিষয়টা যেন শুধুই গুজব হয়। কেন এমন হচ্ছে তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। তনুর বাবা ইয়ার হোসেন থানা থেকে ফিরেছেন কিছুক্ষণ আগে। মেয়েটার হত্যার বিচারের জন্য অনেক ধকল সইতে হচ্ছে লোকটার। দৌড়ে তাকে ডেকে আনতে হবে। ফিরে আসা মেয়েকে দেখাতে হবে। তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।

টর্চ নিয়ে তারা যখন কলতলায় এলো, তখন সেখানে কাউকে দেখতে পেল না। কেবল বালতিটা খালি। সন্ধ্যার আগে বালতিটা ভরে রেখেছিল তনুর মা।

-তোমার কোনো ভুল হচ্ছে না তো?

আনোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞেস করে তনুর বাবা।

-আমি আবছায়ার মধ্যে দেখছি। তবে ভুল দেখার কথা না। তনুকে আমি চিনব না!

-এমনও তো হতে পারে সারা দিন ওর কথা ভেবেছ বলেই এমন মনে হচ্ছে।

-কী জানি! তবে যদি ও সত্যিই ফিরে আসে?

-তাই আবার হয় নাকি!

খুব দৃঢ় শোনায় না ইয়ার হোসেনের কণ্ঠ। তবু নিজ চোখে না দেখা পর্যন্ত তিনি কোনো কিছুই বিশ্বাস করতে পারছেন না।

 

শেষ রাতের দিকে ইয়ার হোসেনের ঘুম ভেঙে যায়। মোবাইল ফোনে আলো জ্বালিয়ে সময় দেখেন। ফজরের আজানের এখনও খানিক বাকি আছে। এ সময় সাধারণত তার ঘুম ভাঙে না। তনুর ঘর থেকে হঠাৎ একটা শব্দ তার কানে আসে। ঠিক কিসের শব্দ বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, কেউ একজন পা টিপে টিপে হাঁটছে। তনুর ঘর খালিই পড়ে থাকে। ঘর থেকে লাইট-ফ্যান খুলে ফেলা হয়েছে। ও ঘরে এ সময় কারো যাওয়ার কথা নয়। ইয়ার হোসেন একবার ভাবলেন স্ত্রীকে ডাকবেন। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পাল্টালেন। চার্জার লাইট নিয়ে ঘরে ঢুকতেই চমকে উঠলেন। খাটের এক কোণায় উল্টো দিকে মুখ গুঁজে তনু বসে আছে। তিনি কাছে না গিয়ে দূর থেকেই মৃদুস্বরে ডাকলেন।

-তনু! মা তনু!

কোনো জবাব এলো না। তিনি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেন। তনু মুখ তুলল না। কেবল বারকয়েক থুথু ফেলল। তনুর মাকে ডাকা দরকার। আনোয়ারা বেগমের গাঢ় ঘুম হয় না। একবার ডাকতেই তিনি সজাগ হলেন। দু’জনে ছুটে এলেন তনুর ঘরে। দরজা খোলা। ভেতরেও কেউ নেই। কলতলা থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে। এত রাতে কে গোসল করবে? তনু নয় তো!

তনু ফিরে আসার আজ তৃতীয় দিন। তিন দিনে মোট চারবার তার দেখা পাওয়া গেছে। প্রতিবার আলাদা জায়গায়। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। কিছু মুখেও দেয়নি। কেউ সামনে এলে শুধু থুথু ফেলছে। পুলিশের বিশেষ বাহিনী গ্রামে টহল দিচ্ছে। তনুর বাবা-মাকে বিশেষ নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। মসজিদে প্রতিদিন বাদ আসর মিলাদ পড়ানো হচ্ছে। যে যা পারছে মানত করছে। দোষ কাটানোর জন্য।

তনু থানায় বসে আছে। চেয়ারে মুখ নিচু করে। নিশ্চুপ-নিথর হয়ে। পুলিশ তাকে খুঁজতে ব্যর্থ হয়ে যখন ফিরে এসেছিল, তার পরপরই তনু থানায় এসে হাজির। কনস্টেবল তাহের তাকে প্রথম দেখে। বড় স্যার অফিসে ছিলেন না। ফোন করে তাকে খবরটা জানানো হয়। তনুকে কেউ জোর-জবরদস্তি করছে না। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। তিনি বিচক্ষণ ব্যক্তি। দেখে বয়স আন্দাজ করা যায় না। সবসময় মিষ্টি একটা হাসি মুখে লেগে থাকে। তনুর সার্বিক অবস্থা বুঝতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। মিডিয়াকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তারা ঘন ঘন আপডেট জানতে চাচ্ছে। ওসি সাহেব কৌশলে তাদের থামিয়ে রেখেছেন।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। থানার লাইটগুলো একে এক জ্বলতে শুরু করেছে। ওসি সাহেবকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। তনু তার অবস্থা বদলায়নি। একবারও মুখ তুলে কারো দিকে তাকায়নি। ওসি সাহেব তনু ধর্ষণের মামলার নথিগুলো ভালো করে দেখছেন। কয়েকদিন আগে ছবিসহ সন্দেহভাজনদের একটা তালিকা করা হয়েছিল। অনেকের ছবিই সেখানে আছে। ওসি সাহেব দ্রুত ছবিগুলো আলাদা করে তনুর সামনে রাখেন। তনু হঠাৎ মাথা তুলে ছবিগুলোর দিকে তাকায়। তার শরীর কাঁপছে। যে কোনো মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে। নিজেকে সামলে নিয়ে শুষ্ক মুখ থেকে একদলা থুথু বের করে দুটি ছবিতে নিক্ষেপ করে তনু। চেয়ার থেকে উঠে ধীর পায়ে বেরিয়ে যায় থানা থেকে। ওসি সাহেব থুথুমাখা ছবি দুটিকে আলাদা করে রাখেন।

অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। সেই অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে সোহাগী জাহান তনু। চোখ-মুখ গলে ঘৃণা আর পৃথিবীর প্রতি তাচ্ছিল্য ভেসে বেড়াচ্ছে। কয়েক হাজার উৎসুক চোখ তার হারিয়ে যাওয়া দেখছে। তাদের মধ্যে কেউ তার বাবা, কেউ মা, কেউ বান্ধবী, কেউ পরিচিত আবার কেউ-বা অপরিচিত। তারাও তনুর মতোই স্তব্ধ, হতভম্ব। কারো কিছুই বলার নেই, করার নেই। তনুকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ওসি সাহেব খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। তার ওয়াকিটকি আর মুঠোফোন নিরন্তর বেজে চলেছে। নানা জায়গা থেকে সংবাদ আসছে। শুধু তনু নয়; তার মতো ইয়াসমীন, সীমা, সুরাইয়া, রুমি, সিমিরাও ফিরে আসতে শুরু করেছে একে একে।

তবে কি সত্যিই তনুরা ফিরছে?