November 22, 2024
কলাম

আমরা আবার আসবো, সবুজ হয়ে হাসবো

শাওন মাহমুদ।।  গত পরশু বন্ধুবৌ মেসেঞ্জারে একটা ছবি পাঠালো আমায়। ড্রয়িং রুমে ছোট্ট একটা তাবুর মধ্যে বন্ধু বসে তার দুজন পুত্রের সাথে লুডু খেলছে আর চিপস খাচ্ছে।

বন্ধুবৌ লিখলো, আপা কলিজাটা ঝাঝড়া করে ফেলছে ওরা, সারাদিন বাসায়, খুব জ্বালাচ্ছে। সাথে সাথে তাকে উত্তর দিলাম, এমন সময় আর পেয়েছো কখনও? আর পাবেও না। বন্ধু সারাদিন ব্যবসার কাজে বাইরে ছুটতে থাকে। বাচ্চা দুটো স্কুল আর কোচিং শেষে রাতে পড়তে গিয়েই ঘুমিয়ে যায়। অথচ দেখো এই যে করোনা ভাইরাস থেকে সাবধান হবার জন্য আজ তোমরা চারজনা একসাথে খাচ্ছো, খেলছো, রান্না করছো, ঘুমাচ্ছো, এমন সুন্দর সময়গুলোকে হৃদয়ে যত্ন করে রাখো। সব স্বাভাবিক হলে আবার কখনও হয়তো একসাথে ঘরে বসে এতো সুন্দর সময় কাটাতে পারবে না।

বন্ধুবৌ আমার উত্তর পেয়ে অদ্ভুত এক বিস্ময় নিয়ে লিখলো, আমি তো এমন ভাবে ভাবিনি আপা। আজ থেকে এই হোম কোয়ারান্টাইনের প্রতিদিনের ছবি তুলে রাখব, সযতনে। তখন আমিও তাকে বললাম, স্ক্র্যাপবুক তৈরি করে ফেলো। এখন তো আর ছবি প্রিন্ট করতে পারবে না, তবে দিনগুলোতে কী কী করেছ তা একটা নোটবুকে টুকে রাখ। তারিখ মিলিয়ে পরে ছবি ডেভেলপ করে সেঁটে দিও।
বুঝলাম মন শান্ত হয়েছে তার, আনন্দে কাটাবার প্রস্তুতি নেয়া হয়ে গেছে মনে মনে।

করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় পুরো পৃথিবী থমকে গেছে। আমরাও হয়েছি ঘরবন্দী। নিজেদের আটকে থাকবার সময়টা বাঁধা নেই। অনিশ্চয়তার মাঝে ছুটি উপভোগ করবার অভ্যাস কারো নেই। ঘরে বসে থাকতে থাকতে আমাদের মাঝে বিষন্নতা, উদ্বেগ, অস্থিরতা কাজ করছে। আশপাশের মানুষকে তাই বারবার বলছি, শান্ত হও। স্থিরতা আনো মনে। উপদেশ দেয়াটা সহজ অনেক, মানতে পারাটা কঠিন। গত দুইদিন ধরে তারপরও ঘরবন্দী পরিবারগুলোর মন শান্ত করবার উপায় বের করবার চেষ্টা করেছি। উপদেশ নয়, ভালো থাকবার উপায় বের করবার চেষ্টা করেছি।

এখন তো অনলাইনের যুগ। ইউটিউব থেকে বহু কিছু শেখার পদ্ধতি জানা যায় খুব সহজে। যেমন ঘরে যদি পরিমিত কাগজ আর ভালো কাঁচি থাকে, তাহলে ওরিগামি করতে করতে সময় পার হবে দারুণ। তাছাড়া শিশুরাও খুব আনন্দ পাবে ওরিগামি বানাতে গিয়ে। অনেকের বাসায় ফেব্রিক পেইন্ট থাকতে পারে, বাচ্চাদের গেঞ্জি বা রুমালে নকশা এঁকে দিলে সহজেই রঙ তুলিতে রাঙাতে পারবে অনেকটা সময় ধরে। রঙ শুকালে গায়ে দিলে তাদেরও ভালো লাগবে, নিজের করা কাজ। বড়রাও ফেব্রিক পেইন্টের কাজ করতে পারেন আরামসে। বিদেশি ভাষা শিখতে পারেন বিভিন্ন ভিডিও থেকে। ছোট ছোট ভিনদেশি শব্দ, বন্দী সময়ে সবার আনন্দের খোরাক হবে। বিদেশি শব্দে গোপন কোড বানিয়ে নিজেদের মাঝে খেলা করতে পারবেন সকলে মিলে।

খাবারের সাথে ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে। আামাদের দেশে রান্না করে সাধারণতা মা। বাবা খাবার রান্নার কাজে এগিয়ে আসাটা আমাদের সমাজে খুব একটা পরিচিত দৃশ্য নয়। এই ঘরবন্দী সময়ে মা বাবাসহ সবাই মিলে ছোট খাটো মজাদার খাবার রান্না করলে, খাবার আর রান্নার সাথে সাথে পারিবারিক ট্যাবুগুলো থেকে বের হওয়া যাবে খুব সহজে। ঘর পরিষ্কার করা, বইগুলো গুছানো, এমনকি এই সময়টায় শিশুদের নিজ বিছানা গুছানো, নিজের কাপড় ভাঁজ করে রাখা, খেলনা গুছিয়ে রাখা, খাবার পর নিজের থালাটা ধুয়ে রাখার মতন বহু ছোট ছোট কাজগুলো তাদের সাথে বাবা আর মা এক হয়ে করতে থাকলে, আগামীতে দায়িত্ববোধের অভাব হওয়ার কথা নয়। আর সময়ও পার হবে খুব ভালো করে।

এই সময়ে বই পড়বার সাথে সাথে একটু লেখার অভ্যাস করাটাও মন্দ নয়। সেটা দিনলিপি হোক, কবিতা বা মতামত। অন্য কারো জন্য নয়, নিজের জন্য লিখে রাখাটা কিন্তু দারুণ কাজের। আর পরিবারের সবাইকে নিয়ে আরেকটা মজার কাজ করা যেতে পারে এখন। প্রতিদিন সবার এ্যাক্টিভিটি লেখা এবং ছবি তুলে রাখা। দারুন পারিবারিক স্ক্র্যাপবুক হবে। ঘরে বয়স্করা থাকলে তাদের সাথে বসে বড় কাগজে ফ্যামিলি ট্রি তৈরি করতে পারেন। পূর্বসূরীদের যে পর্যন্ত নাম পাওয়া যায় আর অন্যদিকে উত্তরসূরীদের জন্য জায়গা খালি রেখে দেবেন। জানেন, সম্পূর্ণ করবার পর এই ফ্যামেলি ট্রি একদিন আপনাদের বাসায় বাঁধানো হবে ঠিক!

কলকারখানা, যানবাহন বন্ধ হয়ে গেলে আর কয়েকদিনের মাঝে বাতাসের দূষণ কমে আসবে। রাতে তারা দেখবার জন্য পরিষ্কার আকাশ পাওয়া যাবে। যাদের বাসায় দূরবীন আছে, তারা ছেলেবেলায় শেখা তারাদের খুঁজে বের করতে পারবেন সহজেই। আমার সময়ে যদিও খালি চোখেই তারা চিনতে পারতাম আমরা। বিশাল এক জ্ঞানের বিষয় ছিল তখন, আকাশের তারাদের চিনে নাম বলতে পারাটা। শিশুরা যখন বই পড়বার পাশাপাশি নিজের চোখে আকাশের তারা দেখতে পাবে, তখন তাদেরকে আপনার ছেলেবেলার গল্প বলবেন। রাতে কান পাতলে ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে পাচ্ছি দু’দিন ধরে। খুব তাড়াতাড়ি পাখীরা ফিরে আসবে আমাদের আশপাশে। ঘরে বয়স্কদের সাথে বসে সবাই মিলে তাদের ছেলেবেলার গল্প শুনুন। ওনাদেরও সময় ভালো কাটবে, নস্টালজিয়া অনেক সময় হৃদয়কে স্বতঃস্ফূর্ত করে তোলে, যা বয়স হবার পর শরীরকে রাখে সতেজ।

যেহেতু সবার আউটডোর এ্যাক্টিভিটি নেই, তাই ঘরেই একটা সময় বেঁধে সবাই মিলে স্ট্রেচিং, ইয়োগা, ফ্রিহ্যান্ড ব্যায়াম করলে শরীরটাও চাঙ্গা থাকবে, সাথে মনও। আপনার সাথে বাবা, মা অথবা যে কোন বয়স্ক মানুষ থাকলে তাদেরকেও সঙ্গে নেবেন। লুডু, ক্যারাম, কার্ড, মনোপলি, শব্দ বিভ্রাট, স্পেলিং বি ইত্যাদি খেলাগুলো সবাই মিলে খেলতে পারলে অন্য এক ধারায় আনন্দ আসবে এবং স্ক্রীনআসক্তি থেকে খানিকটা হলেও বের হওয়া যাবে। চোখ দুটো আর মাথার ক্লান্তি কাটবে। আরো কত কিছু করবার আছে, ‘কিচ্ছু করার নেই’ বিষন্নতা থেকে উঠে বসুন, দেখবেন মাথায় কিলবিল করছে আইডিয়া।

করোনা ভাইরাসের আক্রমণে সবাই কঠিন ঘরবন্দী হয়েছে ঠিক, তবে এ সময়ে পরিবারের সাথে থাকবার বিষয়টা একদম আলাদা করে দেখছি আমি। অচেনা শত্রুর সাথে লড়াই করছি, অনিশ্চিত সময় পার করছি। জানি শান্ত থাকাটা কঠিন। তারপরও অনুরোধ, করোনা ভাইরাস মোকাবেলা করবার জন্য বাড়িবন্দী দিনগুলোকে ইতিবাচকভাবে নেয়ার চেষ্টা করুন। পরিবারের সাথে একান্তে কাটানো সময়গুলো মহামূল্যবান আগামীর জন্য তুলে রাখুন। জীবনযাপনের ব্যস্ততায় হয়ত এত কাছাকাছি, এতটা সময় ধরে আবারও পরিবারের সবাই একসাথে নাও হতে পারে। মন শান্ত করতে করতে ভালোবাসার মানুষগুলোর সাথে আলোকিত মুহূর্ত তৈরি করুন।

ইতালির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সময়েও আমার ইতালিয়ান বন্ধু সিনজিয়ার একটা অসাধারণ লেখা দিয়ে আজ শেষ করছি। “আমরা ফিরে যাবো হাঁটতে, ভ্রমণ করতে, সূর্যস্নান করতে। চুম্বন আর আলিঙ্গনে, সবার মাঝে হাত নাড়তে। বন্ধুদের সাথে পাবে ফিরে যাবো, কফি খেতে একসাথে। সন্ত্রাস ছাড়া আমাদের মুখ স্পর্শ করতে। সাথে নিয়ে যাবো সন্তানদের। আমরা আবার চকমক করতে ফিরে আসবো।”
এটা পড়বার পর আমি সিনজিয়াকে লিখেছিলাম, “আমরা আবার আসবো, সবুজ হয়ে হাসবো।”

লেখকের অন্য লেখা পড়ুন- বঙ্গবন্ধু: নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও সমতার অন্য নাম