September 20, 2024
কলামফিচার ২

করোনা’র কালে

ক্যামেলিয়া আলম।। আলবেয়ার কামুর প্লেগ উপন্যাসটি যাদের পড়া আছে তারা জানেন যে, সমুদ্রের তীর ঘেষে উজ্জ্বল আলোকিত এক নগরীতে বাস করা উত্তাল মানুষগুলোর ঝরে যাওয়া। যারা কোয়ারেন্টাইনড হয়েছিল সারা জগত থেকে শহরটিকে আলাদা করে যাতে ভাইরাস ছড়িয়ে না যায়। শহর ছেড়ে পালাতে চেয়েছিল কেউ, কোথাও যাওয়ার নাই বলে থেমে গিয়েছিল কেউ, হিংসায় উন্মত্ত হয়ে স্বার্থপরতার দ্বন্দ্বে জয়ী হয়েছিলো কেউ, ভালোবেসে মানবিক লড়াই দিয়ে থামাতে চেয়েছিলো কেউ, একে একে মৃত্যু হল। বেঁচে রইলো হিংসাহীন, উন্মত্তার বাইরে বেরিয়ে মানুষের জন্য, মানুষের হয়ে লড়াইয়ে নামা ডাক্তার রিও প্রকৃতি যাদের করুণায় ফেলে গেছে তাদের নিয়ে!
এভাবেই বেঁচে থাকা হয়, বেঁচে থাকতে হয়। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। প্রকৃতি আজ আমাদের যখন আচমকা থামিয়ে দিলো, আমরা আতংকিত হলাম, ভয় পেলাম, এরপর দেখলাম, নাহ, ভয়ের তো কিছু নাই। এ তো ভালোবাসার এক নতুন পৃথিবী!

ওড়িষ্যার তীর ঘেষে সোয়া লক্ষ ক্ষুদে জলপাই রডলি কচ্ছপগুলো আজ প্রথম সূর্যোদয় দেখলো, বিরান সমুদ্র তীরে ছিলো না জনমনিষ্যি। শত শত মায়ের আজ উদ্বেলিত সমুদ্র যাত্রা। ভেনিসের শ্যাওলা রঙা পানি কেমন নীলচে হওয়া শুরু। চার দেয়ালে ঘেরা বদ্ধ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি দূরবীণে চোখ ঠেকিয়ে দেখে স্বচ্ছ পানিতে রঙীন লেজের উল্লসিত ছুটোছুটি। বিলুপ্তির পদযাত্রার ধ্বনি যখন বাজাচ্ছিল বেজার পরিবেশবিদেরা। হাসিমুখের ডলফিনগুলোকে বাড়ির কাছটায় দেখে বাচ্চাদের হুল্লোড় যেন মৃতপুরীর দেয়ালগুলোয় নতুন প্রাণ জাগালো। সমুদ্র নীল হওয়া শুরু হল, মা ডলফিনকে মরতে হচ্ছেনা আর প্লাস্টিক বোতল ভরা পেটটি নিয়ে। নতুন কোন দাবানল জ্বলে উঠলো না আমাজানের পাতায় পাতায়। ভীত, কাঁপতে থাকা কোয়েলা এসে মুখ গুজলো না অজাতশত্রুর কাছেই। বন ছেড়ে ভাল্লুকগুলো দীর্ঘদিন পরে বেরিয়ে এলো খোলা রাস্তায়, অস্ট্রিচ দিব্যি হেঁটে গেল জনারণ্যে ভরা ভারতের কোন এক রাস্তায়। নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডে ঢাকা গনগনে সোনালী আকাশটা আবার নীল দেখা গেল স্যাটেলাইটের ক্যামেরায়। যা পৃথিবী দেখে নাই বহুকালে। যন্ত্রের তাণ্ডব থামবার পরের মাছরাঙা আকাশে দলে দলে উড়তে থাকলো বিহঙ্গকূল। মক্কার কাবার সোনালী মিনার ঘিরে, ভ্যাটিকানের সোনালী চূড়াটি ঘেষে চক্রাকার ঘুরতে থাকা পাখিগুলো দেখালো প্রকৃতির নাই আলাদা ধর্ম।

প্রকৃতি ঠিক কখন থেকে আমাদের এতোটা দূরে সরে গেল যে আমরা যখন মুখ ডুবিয়ে দিলাম চোরাবালিতে ঠিক তখনই সে হাসিমুখে বেরিয়ে এলো! যখন প্রকৃতির জন্ম রহস্যের আধাআধি আমরা বুঝে নিলাম। দেখলাম আমাদের ফেলে দেওয়া বীজ অল্প কিছুকাল পরেই বাদামী শক্ত আবরণ আচমকা সরিয়ে সবুজ গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এলো। আমাদের প্রাথমিক বেঁচে থাকার যাযাবর লড়াই গেল থেমে, আমরা প্রকৃতির বুকে বাড়তে বাড়তে দলবদ্ধ হলাম, নিজের দল ছেড়ে প্রকৃতির আলাদা দুর্বল জাতের উপর আমরা সবল হবার টেকনিক শিখলাম, ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’- আদর্শের জন্ম নিয়ে আমরা একে একে দুর্বল মনে হওয়া প্রতিটি বস্তুর উপর আমাদের আধিপত্য চাপালাম। আধিপত্যের জগতে আঘাতে পালাতে না পারা গাছ, ছুটতে থাকা দুর্বল প্রাণির মতো প্রয়োজনীয় মানুষকেও বশ মানালাম। পাহাড়ের গিরিশৃঙ্গ বেয়ে আসা আর্যরা যেমন বশ মানাতে পেরেছিলো অনার্যদের। জন্ম নিলো মানুষের সমাজের উঁচু নিচু রূপের। প্রভু- ক্রীতদাস, পুরুষ  নারীর এক অসম অবস্থান। জয়ী দল গড়লো নতুন পৃথিবী।
নতুন পৃথিবী স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখালো। কথা বলার কথা বললো। দর্শন, জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প নতুন করে তৈরি হল। মানুষ আরামে থাকতে শিখে গেলো, যন্ত্রের আবিষ্কারক প্রকৃতির চেয়েও ক্ষমতাবান হবার আত্মম্ভরিতায় ভুগতে শুরু করলো। ‘নিজের জন্য যা ভালোবাসবে না, তা অন্যের জন্য করতে যেও না’ – কনফুসীয় মতবাদের চেয়ে ‘ আমিই শ্রেষ্ঠ’ দর্শন, শিল্প, বিজ্ঞান ধারণা প্রশ্রয় পেলো। এই ধারণায় ছেয়ে দুইটা বড় যুদ্ধ হয়ে গেল, প্যালেস্টাইনে মারা গেল লাখ লাখ মানুষ, ইরাক, সুদানে ওষুধের অভাবেই সাধারণ রোগে মারা গেল লক্ষ লক্ষ মানুষ, যারা বেশিরভাগই শিশু, সন্ত্রাসবাদের জন্ম নিলো নিকারাগুয়া থেকে মিয়ানমার, কসোভো থেকে পূর্ব তিমূর একই সাথে রক্তাক্ত হলো। সুদানের উদাহরণ ইরানে এসে ভীড় জমালো যখন গুটিপায়ে অসংখ্য শুঁড় তোলা এক পরমাণু আকৃতির কীট চায়না থেকে বেরিয়ে তীব্রবেগে ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত পৃথিবীতে। শিল্প বিজ্ঞানের মাথা উঁচু করা ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ থেকে মরুভূমিতে ভেঙে পড়া ‘ বৌদ্ধ মন্দিরে’র পাশে অসহায় নির্লিপ্ত মানুষটিও মুক্তি পেল না। নির্বাক প্রকৃতির উপর নিষ্ঠুরতার শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির বাজারি সমাজ আর অতিমাত্রার ব্যক্তিক অচলায়তন ঠিক তখনই ভেঙে পড়লো।

নতুন আরেক আগাম পৃথিবীর যাত্রাকাল এখন। আমরা দেখতে পেলাম মাত্র দুই মাসের বন্ধ কলকারখানা আমাদের আকাশ, সমুদ্রকে কত গভীর নীলে ভরিয়ে দিলো। প্রকৃতির হত্যাচারিতা বন্ধ হওয়ায় প্রকৃতির প্রাণ কী করে আবার পাখনা মেললো। বহুদিন আমাদের দেখা হয়নি বুড়ো বাবার বলিরেখায় ঢাকা কপালখানি, বুড়ো মায়ের রগ বের হওয়া হাত কী করে সংসারটাকে গুছায়, ফুলো মুখের আদুরে মুখখানার মেয়েটি কী করে চর্মসার হয়ে যাচ্ছে। সবই কি নতুন করে দেখবার নয়?

আজ পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্রের মোড়কে করে যা এসেছে তাতে কি আসলেই সাম্যের কোন কথা বলেছে? পুঁজিবাদ যেমন নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে, সমাজতন্ত্র কি চালায়নি? সাম্য মানে তো শ্রেষ্ঠত্বের বড়াইয়ের সংজ্ঞায়ন না। অর্থ বা জ্ঞান যা দিয়েই নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাববার চেষ্টা , তার চেয়ে বড় আধিপত্যের চেহারা আর কী থাকতে পারে?

পুঁজিবাদের ‘আইসোলেশন’ আর সমাজতন্ত্রের ‘সাম্য’ নতুন রূপে ভাববার সময় এসেছে এখন। যে যন্ত্র, শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আমাদের নিজের মানুষকেই বিচ্ছিন্ন করে বাঁচতে শেখালো তা কি আমাদের বাঁচাতে পারলো? চিকিৎসায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী দেশটিতে যে মৃত্যুর মিছিল দেখা গেল তা কি দলে দলে দেখেনি আফ্রিকার কালো মানুষেরা বা ল্যাটিন আমেরিকানরা? ওভার টাইম কাজ, ছুটির দিনেও ঘরকে আপন না করতে দেওয়া কারখানা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখছে, কোটি কোটি সম্পদের পাহাড় তলিয়ে যাচ্ছে। ভয় পাচ্ছি কি আমরা? অর্থ সম্পদের প্রাচুর্য আমাদের কি বিচ্ছিন্ন করেনি সমাজ সংসার থেকে? তার চেয়েও এ কি বড় ক্ষতি?

সমাজতন্ত্র যে সাম্যের ভাবধারা দিয়ে এক করতে চাইলো, সেখানেও জন্ম নিলো কর্তৃত্ব আধিপত্য চাটুকারিতা! উত্তর কোরিয়া আজ ভাইরাসকে ঠেকিয়ে রাখতে মানুষ হত্যা করলো বলে শোনা যায় , চায়নায় প্রায় ৭৫ লক্ষ গ্রাহক আচমকা নাই হয়ে গেল বলে দাবি জানাচ্ছে মোবাইল কোম্পানীগুলো। প্রায় ৮৫টি দেশ একত্রিত হচ্ছে চায়নার বিরুদ্ধে ‘করোনা ভাইরাসে’র অভিযোগমালা নিয়ে। পুঁজিবাদের আধিপত্যের চেহারার আরেক রূপ দেখালো সমাজতান্ত্রিক আধিপত্যবাদীরা। দুই আদর্শের চেহারা তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো?

আমাদের সময় এসেছে ভাববার। দলে দলে কারা মারা যাচ্ছে করোনাকালে ? চায়না, আমেরিকা, ইতালী, স্পেনের উন্নত জাতির অ্যালকোহল, মিষ্টি কৃত্রিম পানীয় আর প্রিজারভেটিভযুক্ত খাবারের অভ্যস্ততায় ভরা ফুসফুস প্রাকৃতিক লড়াই এ যেমন হার মানলো, তেমনই সুদান, আফ্রিকার না খাওয়া বুভুক্ষু শরীরগুলোও হার মেনে গেল প্রাকৃতিক লড়াইয়ে। চরম স্বেচ্ছাচারীতা আর চরম অবহেলিত জীবনযাত্রার প্রাকৃতিক লড়াই এ হারতে থাকা উদাহরণ আমাদের কী শেখালো?

আমরা ভাবতে থাকি, গভীরভাবে ভাবতে থাকি। আমরা কি সেই পুরনো আদর্শ আর পৃথিবীতেই ফিরে যেতে চাই কি না! নাকি জন্ম দিতে চাই একদম নতুন আদর্শের! সকলের সাথে চলাটা বড় ধীরগতির! তবু চলি না! জীবন তো একটাই।