November 22, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

ও-তে ওড়নাবিহীন জীবন!

সান্দ্রা নন্দিনী।। আমি এমন এক দেশ ও সমাজের প্রতিনিধিত্ব করি যেখানকার মেয়েদের জীবনে ওড়না একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এদেশের সমাজে ওড়না একজন নারীর জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যাকে বলে একেবারে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। নারী এবং ওড়না প্রায় সমার্থক শব্দ বলা যেতে পারে। অর্থাৎ একজন নারী যৌবনপ্রাপ্ত (ইচ্ছে করেই একটু চটিবইমার্কা ভাষা দিলাম!) হতে শুরু করার সময় থেকে একেবারে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার আগ পর্যন্ত ইহা তার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হইয়া ওঠে বা হওয়াইয়া ওঠানো হয়!! রাস্তায় ওড়নাবিহীন নারী মানে সে মোটামুটিভাবে একজন খুনির সমান অপরাধী। খুনিরও জামিন মেলে কিন্ত ‘এইসব’ মেয়েদের অপরাধ একেবারেই ক্ষমার অযোগ্য। ‘এরা’ রাস্তার মেয়ে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই ‘এদের’ বাপের ঠিক নেই!!!

অল্প ক’বছর আগের ঘটনা যদি মনে করি, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডকর্তৃক প্রকাশিত প্রথম শ্রেণির বাংলা বইতে ছাপা হয়েছিলো, ‘ও’-তে ওড়না চাই। যদিও এর আগপর্যন্ত আমরা ‘ও’-তে ওষুধ খেতে মিছে বলাই পড়ে এসেছি। পরে অবশ্য বহু জল ঘোলা হওয়ার পর এটাসহ আরও নানা ভুল(?) সংশোধন করে বই ছাপতে দেওয়া হয়েছে। তবে বন্ধুরা এটা থেকে আমরা কী শিখলাম? প্রাথমিক শিক্ষাবোর্ডে থাকা মহামান্য ব্যক্তিবর্গ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, জীবনে ওষুধের চেয়েও ওড়না অধিক গুরুত্ববহনকারী একটি জিনিস। এর সাথে সাথে আরেকটি বিষয়কেও ছোট করে দেখার কোনও সুযোগ নেই যে ক্লাস ওয়ানের একটি মেয়েবাচ্চার জীবনেও ওড়না কম গুরুত্বপূর্ণ নয়!

তো এই যখন পারিপার্শ্বিকতা সেখানে আমি কোথাকার হরিদাসী যে এরথেকে মুক্তি পাব? যথেষ্ট বিরক্তিকর মনে হত বলে ওড়না পুরোপুরি বর্জন করতে না পারলেও বিষয়টি বিলম্বিত করতে আমি স্বাভাবিকের চেয়ে একটু দেরিতেই সালোয়ার-কামিজ পরতে শুরু করেছিলাম। কলেজে ওঠার আগ পর্যন্ত আমি পারতপক্ষে এর ধারেকাছেও ঘেঁষিনি যেখানে আমার সমবয়সীরা ক্লাস সিক্স/সেভেন থেকেই সালোয়ার-কামিজ এবং সাথে অবশ্যই ওড়নায় চলে গিয়েছিল। কলেজে ফার্স্ট ইয়ার পর্যন্ত স্কার্ট আর ফ্রক পরেই বাইরে বেড়াতে গিয়েছি, প্রাইভেট পড়তে গিয়েছি। কলেজ ইউনিফর্মের সাথে ওড়না পরা বাধ্যতামূলক থাকলেও পরিনি। কেননা অনেক চিন্তা করেও ইউনিফর্ম হিসেবে ক্রসবেল্ট থাকার পরেও তার ওপরে বাড়তি ওড়না ঝোলানোর কার্যকারিতা বা গুরুত্ব কোনটিই আমার ছোটমাথায় ঢোকেনি।

যাহোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই আমি সম্পূর্ণভাবে সহি নিয়মে (অবশ্যই দুইপাশ ঢেকে) ওড়না পরিহিতা একজন চরিত্রমতি নারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি। সারাক্ষণ ওড়না টানাটানি করে ঢেকেঢুকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা ছিল আমার দিনের একটি অন্যতম কাজ। এমনকি অবচেতনেও আমি ওড়না ঠিক করতে থাকতাম। আমার জীবনে সর্বোচ্চ প্রভাববিস্তারকারী শিক্ষক আমাকে প্রায়ই ক্ষেপাতেন এই বলে যে, নন্দিনী মানেই তো (হাত দিয়ে ওড়না ঠিক করার ভঙ্গি করে) এই কাজে ব্যস্ত। আমি তো তখন মনেমনে রেগেমেগে একেবারে আগুন। কী! আমার পর্দা নিয়ে টানাটানি?! ঢেকে রাখব না তো কি সবাইকে দেখিয়ে বেড়াব নাকি! যারা ওড়না পরে না তাদের কি সবাই খুব ভাল মেয়ে বলে? আমাকে কি বাজে মেয়ে পেয়েছে নাকি? স্যার বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে যে সবকিছু নিয়ে কথা বলতে হবে! দেশের বাইরে থেকে পড়াশোনা করলেই একেবারে দেশের কৃষ্টি-কালচার সব ভুলে যেতে হবে! যত্তসব অসভ্যতা…. ছিঃ!

মাস্টার্স পাস করা পর্যন্ত এই ছিলাম আমি। এক অত্যন্ত স্বাভাবিক-পারিবারিক-সামাজিক ওড়না লাভার টিপিক্যাল বাংলাদেশি গুডিগার্ল!

পরবর্তীতে আমার মনোজগতে প্রায় হঠাৎ করেই বলা যায় একেবারে মহাপ্রলয় ঘটে যায়! আমার এত দিনকার টিপিক্যাল পারিবারিক-সামাজিক ও একইসাথে রাষ্ট্রীয় মাইন্ডসেট ভেঙেচুরে গুড়োগুড়ো হয়ে যায়! আর আমার বর্তমান ওড়নাবিহীন-নির্লজ্জ জীবনযাপনই এর প্রমাণ!

আমার মনে প্রশ্ন তৈরি হতে থাকে যে ওড়না তথা যাবতীয় পর্দার আইটেম যেগুলো পরা হয় সেগুলোর মানে বা ভিত্তিটা আসলে কী? পোশাক পরার পরেও বুকের ওপর একটা বাড়তি কাপড় ঝুলিয়ে ঢেকে রাখা আসলে কি এটাই প্রমাণ করতে চাওয়া যে ভাইসকল এই দেখুন, আমি একজন নারী হয়ে জন্মালেও আমার বুকে আর কিছুই খুঁজে পাবেন না! দেখুন, সব ভ্যানিশ! আপনার বুক আর আমার বুকের মধ্যে আজ থেকে আর কোনও পার্থক্য থাকলো না! নারী-পুরুষ ভাই ভাই!

কিংবা মাথাটাকে একটা বাঁধাকপি বানিয়ে হিজাব পরে থাকার অর্থ কী? পুরুষসমাজের চোখে সেক্সঅ্যাপিলের ভয়ে আমার পারসোনা থেকে ভলিউম লেয়ারকাট করা, সানসিল্ক দিয়ে ধোয়া চুল সব নাই করে দিলাম? যা দেখামাত্র কামভাবে ভাইজানদের অবস্থা একেবারে টাইট হয়ে যায় আমার মাথায় সেই সর্বনাশা চুল বলে আর কিছু রাখবই না শালা!

আরেকটা যেটা আছে পর্দা হি পর্দার বাপ, মানে বোরকা সেটার দাবি তো আরও ভয়ংকর! মানে আমার শরীরটাই নেই! আর থাকলেও সেটা আমি স্বীকার করি না! না না নাআআআআআ………এ হতে পারে না….আমি বিশ্বাস করি নাআআআআআ…আহহাহা..(অঝোরে কান্না!)

এই সবকিছুর মানে কি তাহলে এই দাঁড়ালো যে, একজন নারী হিসেবে যে শরীর নিয়ে জন্মেছি সেটা এতটাই লজ্জাজনক একটা বিষয় যে একে নিয়ে আমি কী করব না করব ভাবতে বসতে হবে? নাকি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলেই পড়ব? নাকি এই লজ্জা আমি কোথায় রাখি! এরচেয়ে তো মরে যাওয়াও অনেক ভাল- মার্কা ভাব করে একটা অস্বাস্থ্যকর পোশাক পরে মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঢেকেঢুকে বস্তা সেজে বসে থাকব?

পৃথিবীর সবাই জানে নারীশরীর দেখতে কেমন হয়। পুরুষশরীরের তুলনায় কী কী ভিন্নতা থাকে এবং ঠিক কী কী কারণে থাকে তাও সবার জানা। তবু এটা নিয়ে এই ছ্যাবলামির মানে কী??

পোশাক-সংস্কৃতি সবসময়ই সেই অঞ্চলের আবহাওয়া এবং ভৌগলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। আমাদের দেশের মানুষের পোশাক এখানকার আবহাওয়া অনুযায়ী হবে। আবার একইভাবে মরুভূমির পোশাক সেখানকার আবহাওয়া উপোযোগী হবে এটাই স্বাভাবিক। মরুঅঞ্চলে ধুলিঝড় থেকে বাঁচতে অবশ্যই চুল থেকে পায়েরপাতা পর্যন্ত সব ঢেকে রাখতেই হবে যেমন ভারতের রাজস্থানবাসীরা রাখে।

একজন নারী হিসেবে যে শরীর নিয়ে আমি জন্মেছি তার কোনও একটা অংশ নিয়েও আমার এতটুকু অস্বস্তি, লজ্জা বা অপরাধবোধ নেই। আমার শরীরকে আমি অত্যন্ত সম্মান করি তাই এর কোন একটি অংশও আমি বাড়তি এক বা একাধিক কাপড় দিয়ে ঢেকে তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করার প্রয়োজনবোধ করি না। কেননা, নিজের শরীরকে অপমান করার কোনও অধিকার আমার নেই।

কেউ কেউ বলেন যে, ওড়না বা পর্দা ছাড়া রাস্তায় বের হওয়া আমাদের সমাজ ভাল চোখে দেখে না। এর উত্তরে যদি বলি, এর দায়ও আপনাকেই নিতে হবে। কেননা, আপনিই আপনার সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর কোনও চেষ্টাই করেননি। সমাজের ঠিক করে দেওয়া পোশাক পরে পরে ভাল মেয়ে সেজে বেড়িয়েছেন কিন্তু সমাজকে কেন শেখাননি যে একজন মানুষ নারী বলেই তার সবকিছুর ওপর খবরদারি করা যায় না? সে কী পোশাক পরবে তা নির্ধারণের অধিকার তার জন্মগত তাই এখানে কোনওরকম মতামত দেওয়ার কোনও সুযোগই নেই! কেন আপনার সমাজের মানুষ এটা জানে না যে, বিকিনি পরে রাস্তায় বের হলেও একজন নারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অধিকার কেউ রাখে না? আপনার সমাজের ভাইজানদের কেন আপনি শেখাতে পারেননি যে এই পৃথিবীতে কেবল মানুষের মত চেহারা নিয়ে জন্ম নিলেই হয় না বরং তার পাশাপাশি নিজের সামগ্রিক ইন্দ্রিয়-অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণও করতে শিখতে হয়?

সান্দ্রা নন্দিনী: সাংবাদিক

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]