পুরুষমাত্রই খারাপ- এ মনোভাব ত্যাগ করুন
আঞ্জুমান রোজী।। নারীবাদ নিয়ে শুধু নারীই কথা বলছে, তা নয় কিন্তু। যুগ যুগ ধরে নারীবাদ নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক পুরুষও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তারা নারীমুক্তির আন্দোলনে কণ্ঠ তুলেছেন, কাজ করছেন এবং অনবরত লিখে যাচ্ছেন। এর ভুরি ভুরি উদাহরণ দেওয়া যাবে। সেসব পুরুষ নারীপুরুষ ভেদাভেদ ভুলে সবকিছুর উর্ধ্বে নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে সচেষ্ট হচ্ছেন। মনুষ্যত্ব আর মানবতার জয়গান গেয়ে যাচ্ছেন নারীমুক্তির কথা বলে। তারই আলোকে পুরুষও যে নারীবাদী হতে পারে, এই বিষয়টির অবতারণা করার চেষ্টা করছি মাত্র। এমন লেখার পেছনের কারণ, অনেক নারীবাদী নারী মনে করেন, পুরুষমাত্রই সমস্যা, পুরুষমাত্রই যন্ত্রণা। পুরুষের কারণেই নারীরা মাথা উঁচু করে চলতে পারছে না, এককথায় সব পুরুষ খারাপ। এমন মানসিকতা পোষণ করার পেছনে অনেক নারীর যৌক্তিক কারণ আছে; তবে একচেটিয়া সব পুরুষকে আমি একই পাল্লায় মাপতে নারাজ। তাহলে আমার জন্ম বিফলে যেতে বাধ্য। কারণ, আমিও এক বাবার সন্তান, যার আলোছায়ায় বড় হয়ে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
নারীবাদ আন্দোলনে পুরুষের অংশগ্রহণের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। উনবিংশ শতাব্দী থেকেই অনেক পুরুষ নারীবাদ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের এই অংশগ্রহণ নারীবাদ আন্দোলনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান ছিল। তারা সমাজের বিস্তৃত ক্ষেত্রে নারীদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করেছেন। ১৮৩৭ খ্রিঃ ফরাসি দার্শনিক ও ইউটোপীয় সমাজবাদী চার্লস ফুরিয়ে প্রথম ‘নারীবাদ’ শব্দটির আনুষ্ঠানিক ব্যবহার করেন। পৃথিবীতে পুরুষ নারীবাদী হিসেবে পরিচিত পারকার পিলসাবারি, দেনিস দিদেরো, পল হেনরি থিরি দলবাক এবং চার্লস লুই দে মতেস্কু, ফরাসী দার্শনিক মার্কুইস দে কুঁদরসে, হেনরি মেইন, জন স্টুয়ার্ট মিল, অ্যাবলিশনিস্ট উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসন, চার্লস লেনক্স রেমন্ড, ন্যাথানিয়েল পিবডি রজার্স, হেনরি স্ট্যানন; উনারা তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজে প্রভাবশালী ছিলেন। কেউ ছিলেন ইতিহাসবেত্তা, কেউ আইনজ্ঞ, কেউ দার্শনিক, কেউ অধ্যক্ষ বা কেউ রাজনীতিবিদ। আবার আমাদের উপমহাদেশে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সৈয়দ আহমদ খান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। উনারা অনুধাবন করেছিলেন, নারী শিক্ষা ও নারী ক্ষমতায়নের প্রয়জনীয়তার কথা।
নারীবাদী পুরুষেরা বেল হুকস এর মতো অনেক নারীবাদী লেখিকার পাশে দাঁড়িয়েও যুক্তিতর্কে অংশগ্রহণ করেছেন। পারকার পিলসাবারি এবং অন্যান্য পুরুষ নারীবাদী মতাদর্শকে ধারণ করেন এবং প্রকাশ্যে নারীবাদী হিসেবে পরিচিত হন। তারা তাদের প্রভাব প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে নারীর অধিকার আদায়ের কাজ করেন। পিলসবারি ১৮৬৫ সালে আমেরিকান ইকুয়াল রাইট এসোসিয়েশন এর সংবিধান এর খসড়া তৈরির কাজে সাহায্য করেন। তিনি নিউ হ্যাম্পশায়ার উইমেন সাফরেজ অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে আসীন ছিলেন।
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকজুড়ে বেশিরভাগ প্রো-ফেমিনিস্ট লেখকেরই উত্থান ঘটে ফ্রান্সে। এদের মধ্যে ছিলেন দেনিস দিদেরো, পল হেনরি থিরি দলবাক এবং চার্লস লুই দে মতেস্কু। মতেস্কু তার এপিস্টোলারি নোভেল পারশিয়ান লেটারে রক্সানা নামে একটি চরিত্র তুলে ধরেন যিনি পিতৃতন্ত্রকে পরাভূত করেছিলেন। এই রচনায় তিনি ডেস্পোটিজমের বিরুদ্ধেও যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। অষ্টাদশ শতকে অনেক পুরুষ দার্শনিককে মানবাধিকার বিষয়ক সমস্যার প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখা যায়। ফরাসী দার্শনিক মার্কুইস দে কুঁদরসে নারীর শিক্ষাগ্রহণকে সমর্থন দেন। এ সময় আইনের চোখে নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে এটা জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করলে উপযোগবাদী জেরেমি বেন্থামের মত অনেক উদারপন্থীগণ প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের সমান অধিকারের দাবি করেন।
উনবিংশ শতকে নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ইংরেজ আইনগত ইতিহাসবেত্তা হেনরি মেইন তার এনশিয়েন্ট ল (১৮৬১) গ্রন্থে পিতৃতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবিতার সমালোচনা করেন। ১৮৬৬ সালে দ্য সাবজেকশন অব উইমেন গ্রন্থের রচয়িতা জন স্টুয়ার্ট মিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নারী অধিকার সংক্রান্ত একটি পিটিশন পেশ করেন এবং রিফর্ম অ্যাক্ট ১৮৬৭ এর একটি সংশোধনীকে সমর্থন করেন। তার প্রচেষ্টাগুলো ছিল বিবাহিত নারীদের সমস্যাগুলোর ওপর। সে সময় ভিক্টোরিয়ান নারীদের বিবাহ অর্থ ছিল তাদের স্বাধীনতা, অধিকার এবং সম্পত্তি বিসর্জন দেয়া। নারী অধিকার আন্দোলনে জন স্টুয়ার্ট মিলের যুক্ত হওয়ার মূলে ছিল হ্যারিয়েট টেইলরের সাথে তার দীর্ঘ বন্ধুত্বের সম্পর্ক, যার সাথে তার বিবাহও হয়েছিল।
১৮৪০ সালে নারীকে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড অ্যান্টি-স্লেভারি কনভেনশনে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেয়া হয়। নারীদের অংশগ্রহণের সমর্থকরা যুক্তি দেখান, দাসত্বমুক্তির উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে নারী ও পুরুষকে একত্রে বসায় নিষেধাজ্ঞা এক ধরণের কপটাচার। এরপরও যখন নারীদেরকে সামনের দিকে বসতে দিতে নিষেধ করা হয় তখন অ্যাবলিশনিস্ট উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসন, চার্লস লেনক্স রেমন্ড, ন্যাথানিয়েল পিবডি রজার্স এবং হেনরি স্ট্যানন নীরবে নারীদের সাথে আসনগ্রহণ করেন। অ্যান্টি-স্লেভারি কনভেনশনে নারীর অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে একটি কথা ছিল; নারীকে পুরুষের দায়িত্বগুলো নেবার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। অ্যাবলিশনিস্ট থমাস ওয়েন্টওর্থ হিগিনসন এর বিরুদ্ধে গিয়ে বলেন:
“আমি ভেবে পাই না, একজন নারী যখন তার চোখ খুলে শ্রদ্ধার বদলে আসা অবজ্ঞাকে দেখতে পান তখন তিনি এই ধিক্কারের শিহরণ কিভাবে এড়িয়ে যেতে পারেন! এটা সেই অবজ্ঞা যা তাকে দীর্ঘদিন যাবৎ আইনগত, রাজনৈতিক এবং শিক্ষাগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে… [একজন নারীর সমান অধিকার প্রয়োজন] এটা এ কারণে নয় যে তিনি পুরুষের ‘বেটার হাফ’, বরং একারণে যে তিনি পুরুষের ‘আদার হাফ’। একজন এঞ্জেল হিসেবে তার এই অধিকারগুলোর প্রয়োজন নেই, তার এই অধিকারগুলোর প্রয়োজন মানবতার একটি অংশ হিসেবে।”
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, আমি একজন নারীবাদী। আমি নারীবাদী হতে পেরে গর্বিত। মাসিক পত্রিকা মরি ক্লেয়ার ডটকমে ‘আন্তর্জাতিক কন্যা দিবস’ উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তিনি আরো বলেন, ছেলে সন্তানদেরকেও নারীবাদী হিসেবে গড়ে তুলুন। আমি আমার সন্তানদের নারীবাদী হতে উৎসাহিত করছি। কারণ কানাডা এবং সারাবিশ্বে নারী এখনও অবহেলিত; সহিংসতা, লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার যা তাদের সীমাবদ্ধ করে রাখে। ফলে তারা স্বপ্নপূরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জাস্টিন-সোফিয়া দম্পতির দুই পুত্র হাদ্রিন ও এক্সাভিয়ার এবং একমাত্র কন্যা এলা গ্রেস মার্গারেট। কন্যা এলা সম্পর্কে জাস্টিন বলেন, আমরা পিতা-মাতা হিসেবে আমাদের মেয়ের জন্য অত্যন্ত গর্বিত।
উল্লেখ্য, নারীবাদী জাস্টিন তার মন্ত্রিসভায় ৫০ মন্ত্রীর মধ্যে ২৫ জন নারী মন্ত্রী রেখে বিশ্বে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
নারীবাদী পুরুষ রাজা রামমোহন রায় ১৮১৮ সালে কলিকাতায় ‘সহমরণ’ বা ‘সতীদাহ’ প্রথা বিলোপের উদ্যোগ নেন। যার ফলে ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারীর শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মেরী ককের সঙ্গে মিলে মোট ৪৩টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৮৫০-৫৫ এ সময়ে বিধবা বিবাহের সপক্ষেও তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ১৮৬৭ সাল নাগাদ নিজে ৬০টি বিধবা বিবাহের আয়োজন করেন।
বিশ্বায়নের দিকে তাকালে এমন অনেক পুরুষ নারীবাদী পাওয়া যাবে যারা নারীকে সঙ্গে করে সাম্য মৈত্রীর বন্ধনে প্রগতির পথে এগিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এমন অনেক পুরুষ নারীবাদী আছেন, যারা নারীকুলের আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন। পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর তার সবটুকুই নারী পুরুষের সম্মিলিত অবদান। নারী যেমন পুরুষ ছাড়া অর্থহীন, তেমনই পুরুষও নারী ছাড়া অর্থহীন। তারপরেও কিছু পুরুষ নারীবাদ নিয়ে যেভাবে বিদ্বেষভাব দেখায়; ঠিক সেভাবে কিছু নারীবাদী নারীও পুরুষের ব্যাপারে বিরূপভাব প্রকাশ করে। ঘরে-বাইরে কিছু পুরুষ তো আমি পেয়েছি , যাদের সহযোগিতায়, আন্তরিকতায় আমার চলার পথ কিছুটা হলেও মসৃণ হয়েছে! উদাহরণ হিসেবে আমার বাবা একজন। বিপরীতমুখী পুরুষও আছে, যারা নারীকে মানুষ বলে গণ্য করতে পারে না। তাদের সেই মানসিকতাই নেই। এর মূল কারণ হীনমন্যতা, অসভ্যতা ও নিম্ন শ্রেণির মানসিকতা। মনুষ্যত্ব বিবর্জিত পুরুষকে কোনো কিছুর গোনায় না রাখাই ভালো। এরা সময় ও কালের শত্রু।
তথাকথিত নারীবাদীদের কারণে আজকে নারীবাদ বিষয়টি সমাজে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। যেন উচ্ছৃঙ্খল এক বাদের অবতারণা করা হয় এই নারীবাদ শব্দ দিয়ে। এরাই পুরুষের ব্যাপারে কট্টর এবং নেতিবাচক ভূমিকা নিয়ে থাকে। এদের অবগতির জন্য বলছি, নারীবাদ শুধু নারীর এখতিয়ারভুক্ত নয়, নারীবাদ মতবাদে অনেক পুরুষেরও অংশীদারিত্ব আছে। অতএব পুরুষকে কটাক্ষ করে নয় বরঞ্চ পুরুষকে বন্ধু ভেবে পাশে রেখে সমানতালে এগিয়ে যেতে হবে।
সবশেষে বলি, নারীবাদ একটি ইতিবাচক শব্দ;,যা সমাজ, সংসার, দেশ, জাতি এমনকি কাল থেকে মহাকালের যাত্রার কথা বলে, বলে প্রগতির কথা, বলে মানুষের কথা। আর যেহেতু সৃষ্টির রহস্যে নারী; তাই সৃষ্টিকে সুস্থ, সুন্দর, চিন্তাধারায় প্রগতির পথে বেগবান করার জন্য পুরুষের তুলনায় নারীর ভূমিকা বেশি অনস্বীকার্য। অতএব ‘নারীবাদ’ নিয়ে যতই কটাক্ষ করা হোক না কেন; যুগে যুগে প্রোফেমিনিস্টরাই এগিয়ে ছিল, আছে এবং থাকবে। কারণ নারীবাদী শব্দ প্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সভ্যতার আরেক ধাপ এই নারীবাদ। নারীবাদ উত্থানে ইতিহাসের যে রূপ ছিল তা এখন চুড়ান্ত পর্যায়ে; অর্থাৎ এর যেমন গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে তেমনি এটি সমাদৃতও। অতএব, নারীবাদ একটি মতবাদ যা নারী পুরুষের সুস্থ চিন্তা চেতনার স্ফুরণ ঘটায়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]