নারীর কোন ধর্ম নেই
লিহান লিমা।। মস্ত বড় এই পৃথিবীর সাড়ে সাতশ কোটি মানুষের পালন করা হাজারো ধর্মের সঙ্গে অভূতপূর্বভাবে জড়িয়ে আছে নারীর অবস্থানের মাপকাঠিটি। আদম শ্রেষ্ঠ, তার গায়ে কালিমা লেপন করা যাবে না, বেহেশত থেকে তার বের হওয়ার পেছনে পুরো দায়ভার হাওয়ার। তাই নারী মাত্রই পাপী, তার পাপের ভার বেশি, জাহান্নামে তাদের সংখ্যাও বেশি। নারীর ওপর পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব মানতে অস্বীকার করা ‘লিলিথ’ তাই ইহুদি সমাজে ঠাঁই পায় না। সে কুলটা, ডাইনী কিংবা শয়তানের সহচরী। মাতা মেরি কিংবা কুন্তির পবিত্রতা রক্ষার্থের পেছনে ধর্মগুরুদের যিশু কিংবা কর্ণের মান রক্ষার প্রয়াস ছিলো কি না তা জানা বড় দায়। যেভাবে জানা বড় দায় যে, ঠিক কবে থেকে ধরিত্রীর বুকে বিষবৃক্ষের মতো ছায়া বিস্তার করেছিলো পুরুষতন্ত্রের বিষফোঁড়া।
রাজার রাজ্য, প্রাসাদের বিলাসিতা ত্যাগ করা সিদ্ধার্থ বৌদ্ধরূপে মানুষকে প্রকৃত জীবনবোধের শিক্ষা দিলেও নিজ প্রবর্তিত ধর্ম নষ্ট হওয়ার শঙ্কায় নারীর সন্ন্যাস গ্রহণে মনক্ষুন্ন হয়েছিলেন। দেবি লক্ষ্মীর সব মহিমার সফল প্রাপ্তি ঘটে নারায়ণের পদ স্পর্শ করে। মহাভারতের দ্রৌপদী কিংবা রামায়নের সীতাকে বইয়ের পাতায় কিংবা টিভি পর্দায় যতটা না মহিমান্বিত করা হয়েছে ঠিক ততটাই আড়াল হয়েছে পুরুষশাসিত ধর্ম ব্যবস্থায় তাদের অসহায়ত্ব আর যন্ত্রণা। হস্তিনাপুরের রাজসভায় পঞ্চপাণ্ডবের কাপুরুষত্বের পাশার গুটি পাঞ্চালি।
মেরি ম্যাগডালিন, জোয়ানা ও সুজানার মতো নারীরা যিশু খ্রিস্টের একনিষ্ঠ ভক্ত হলেও বাইবেল বলে, ‘নারীর মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে পাপ এসেছে।’ সে শয়তানের বাহন, বিষধর সাপ, ছলাকলার অধিকারী ও পুরুষের মনে লালসা উদ্রেককারী। নদী সে, যেখানেই তার উৎপত্তি হোক, হাজারো বাধা ডিঙিয়ে সমুদ্রেই তার স্বস্তি। আজ থেকে হাজার বছর পূর্ব থেকে প্রাধান্য বিস্তার করা পুরুষতান্ত্রিক ধর্মগুলো ঠিক তেমনি নারীর অবস্থানের দিকে এক সুতোয় মিলিত হয়ে যায়। আর এ কারণেই কবরস্থানে নারীর প্রবেশাধিকার নেই, সে অশুচি, পিরিয়ডের সময়ে ধর্ম তাকে ত্যাগ করে এবং জাহান্নামের বাসিন্দাদের অধিকাংশই নারী।
যৌনতায় পুরুষের ওপর আধিপত্য দেখাতে চাওয়া লিলিথকে পৃথিবী বর্জন করেছে হাজার বছর পূর্বে। হাইপোশিয়াকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে মেরেছে ইউরোপীয় সমাজ। নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা নিয়ে অহংকার করা ভারতীয় উপমহাদেশের পুরুষতন্ত্র খনার জিভ কেটে দিয়েছে। মুসলিম ধর্মের তীর্থস্থান মধ্যপ্রাচ্যের রাজকুমার ও ধনাঢ্যরা নিজেদের সুখ খোঁজেন, পত্নী, উপপত্নী ও দাসীতে। ধর্ম তাদের সুযোগ করে দিয়েছে ফসল ফলিয়ে জমির উর্বরতা শক্তি ঠিক রাখার।
অধুনাকালের মানবাধিকারের দৌলতে বইয়ের পাতায় ‘ছেলে-মেয়ে সমান অধিকার’ খচিত হলেও সম্পত্তি বন্টন, বিয়ে কিংবা তালাকের মতো সিদ্ধান্তে রাষ্ট্র প্রচলিত ধর্মগুলোর কাছে বাঁধা। পাশের বাড়ির রহিম চাচা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা পত্রিকার সম্পাদক, যে বাবার শুধুই কন্যা সন্তান তাকে খুব কাছ থেকে বেগ পোহাতে দেখেছি। নিজের পৈত্রিক সম্পত্তিটুকু কন্যার নামে পুরোটা লিখে দেয়ার অধিকার তাকে ধর্মীয় আইনে দেয়া হয় নি। অতীতের সতীদাহ প্রথা, বিধবা বিয়েতে নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে হালের বিদ্যমান মাদার, সেবিকা প্রথা, তিন তালাক, হিল্লা বিবাহের মতো ধর্মীয় বিধানগুলো নারীকে আরো জরাগ্রস্ত, সংকুচিত ও পুরুষতন্ত্রের একনিষ্ঠ সেবক হতে বাধ্য করেছে।
তাই তুমি যতই শিক্ষিতা, সুশীলা আর যোগ্য হও নারী, মনে রেখো, ধর্মে তুমি পতিদেবের পাঁজরের হাড় কিংবা সেবাদাসী।
লিহান লিমা: সাংবাদিক
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]