মস্তিষ্কহীন চরিত্র
শারমিন জান্নাত ভূট্টো।। গেল বছর কোন একজন পুরুষের, (তার পরিচয় নিয়ে নানা মতভেদ আছে, যদিও সব পরিচয়ের আগে মুখ্য তিনি একজন প্রভাবশালী, বিত্তবান পুরুষ) একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যেখানে তিনি মদ্যপান করে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় নাচছিলেন বা নাচার চেষ্টা করছিলেন। এরকম একটি ভিডিও চারিদিকে ছড়িয়ে গেলেও তখন কিন্তু তার চরিত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়নি, প্রকৃত পরিচয় নিয়েও ধোঁয়াশা রেখেই বিষয়টি সবার দৃষ্টি ও মনের আড়ালে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ কি জানেন তো? সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে তিনি পুরুষ। তার কোন ভ্যাজাইনা নেই। থাকলে অবশ্যই তার চরিত্রের পোস্টমর্টেম করা হত, পরিচয় খুঁজে বের করা হত। ঠিক যেমন পাপিয়া নামে অপরাধজগতে বিচরণ করা এক নারী বেশ বেকায়দায় পড়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অপরাধী হবার চেয়েও নারী পরিচয় মূখ্য হয়েছে উঠেছিল তার প্রকটভাবে, তবে বেঁচে গেছে তার দোরগোড়ায় আসা-যাওয়া করা পুরুষ নামগুলো।
যাই হোক, লিখতে বসেছি, যখন চোখে পড়ল জাতীয় দৈনিকের নির্বাহী সম্পাদকের লেখা একটি কলাম, যার শিরোনাম “সানি লিওনের চেয়েও চরিত্রহীন করোনার কাছে যুদ্ধবাজরা অসহায়”। নিছক মজা হোক কিংবা রূপক, একজন র্নিবাহী সম্পাদকের কাছ থেকে শিরোনামের এমন ভাষা বা শব্দ প্রয়োগ কখনোই আশা করা যায় না। যে নারীর নাম এখানে রসিকতা করে ব্যবহার করা হয়েছে এটা কি শুধুই তার পূর্বের পেশার কারণে? সম্পাদক সাহেবের হয়ত জানা নেই, এই নারী অভিনেত্রী তার অভিনয়ের পাশাপাশি দুস্থ ও দরিদ্র শিশুদের কল্যাণে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। নিজের আয়ের অংশ খরচ করছেন অবহেলিত মানুষের মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্য। যাদের আপনারা চরিত্রহীন বলে ডাকেন তাদের ধারে কাছে যেতে হলে আপনাদের আরো কয়েকবার জন্মগ্রহণের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
একটি জাতীয় পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের শব্দের ব্যবহার যদি এমন হয়, তাহলে শিক্ষানবিশ কিংবা তার অধীনে কর্মরতদের কী অবস্থা হবে সেটাই ভাবছি। শুধু তাই নয় চিন্তা করছি সেই সব নারী সহকর্মীদের কথা, যারা তার তত্ত্বাবধানে কাজ করছেন। সেখানে নারী সহকর্মীরা আসলে কতটা নিরাপদ এমন একজনের পাশে কাজ করে? সাংবাদিকতার মত একটি সম্মানজনক পেশায় থাকার পরও কারো ভাষা ব্যবহার যদি এই হয় আর চিন্তাধারার যদি এমন প্রতিফলন ঘটে তাহলে বোঝার বাকি থাকে না তার দৌঁড় কোথায় গিয়ে ঠেকবে।
এখানে কেউ কেউ বলতে পারেন,শুধুমাত্র মজার ছলে নতুবা পাঠক সংখ্যা বাড়াতে এ রনের উপমা ব্যবহার করা হয়েছে। তার মানে এই দাঁড়ালো যে, একটি উচ্চ পদে থাকার পরও একজন সাংবাদিক তার লেখা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন যৌন আবেদনের সুড়সুড়ি আর একটি নারী চরিত্র। কেন কোন পুরুষের নাম আসলো না যেখানে তর্কের খাতিরে হিটলারের নামও ব্যবহার করা যেত! এটা আসলে আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে চরিত্র, পোশাক, সামাজিক-ধর্মীয় নিয়ম-কানুন সবকিছুর জন্যই তলোয়ারটা তুলে দেয়া হয় নারীর ঘাড়ে। পাঠকমহলে বেশ পরিচিত একটি পত্রিকার অবস্থা যদি এই হয় তাহলে তো বোঝার বাকি থাকে না ব্যাঙের ছাতার মতো গজে ওঠা অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমগুলোর কী হাল। সাংবাদিকতার নৈতিকতা আর মান নিয়ে যারা দিন-রাত হাত কচলান বিভিন্ন কর্মশালা আর প্রশিক্ষণে তারাই যখন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এগিয়ে যান তখন তাদের আসলে ঠেকাবে কে?
করোনার দিনে বাসায় থাকছি সবাই, যত্ন নিচ্ছি শরীরের তবে মনের দিকে খেয়াল না করলে যে এমন উল্টোপাল্টা শব্দ বা উদাহরণ কারো কারো থলে থেকে বের হয়ে যায় তার বোধহয় প্রমাণ মিললো। গেল বছর তো একজন স্বনামধন্য রাজনৈতিক নেতাও লাইভ টক শো’তে একজন নারী সাংবাদিককে চরিত্রহীন বলে চেঁচিয়ে উঠলেন আর মুহূর্তেই খসে পড়লো প্রগতিশীলতার মুখোশ। অনেক আগে থেকেই চরিত্রহীন শব্দটি বরাদ্দ রেখে আসছি আশেপাশের চাটুকার, দলকানা, চোর-বাটপার, সুদখোর, ধর্ষক, ধর্ম-ব্যবসায়ী এদের জন্য, আর নির্বাহী সম্পাদকের জন্য নতুন শব্দ খুঁজে পেয়েছি “মস্তিষ্কহীন চরিত্র”।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]