September 20, 2024
নারীবাদ আলোচনাসাহিত্যফিচার ৩

বাংলাদেশে নারীবাদ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক পর্যালোচনা

আতিফ অনিক।। বাংলাদেশে নানান সময়ে নারীবাদ এবং নারীবাদী আন্দোলন নিয়ে আলোচনা শুরু হয় আবার থেমে যায়। এটা হয় মূলত ঘটনাকেন্দ্রীক। কোন ঘটনা ও তার সাথে জড়িত বিষয়গুলোকে কে কিভাবে দেখছে সেটাই মূলত এই সময়গুলোতে ফুটে ওঠে। বাংলাদেশে মূলত নারীবাদের দার্শনিক ভিত্তি এবং এর মূল দিকগুলো নিয়ে সামগ্রিকভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা খুবই সামান্য এবং এই অঞ্চলের নারীবাদীদের এক বড় অংশই স্থুল আক্রমণকেন্দ্রীক। নারীবাদী বলে পরিচিত এক বড় অংশই শাসকদের তাবেদারি করতে ব্যস্ত আবার কেউ কেউ এদের মধ্যেই রয়েছেন যারা নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।

কিন্তু কেন আসলে নারীবাদীরা এই ধরনের আচরণ করেন? এর দার্শনিক ভিত্তিটিই বা কী? আসলে কি এরা বাংলাদেশের বলেই এরকম নাকি সারা বিশ্বেই নারীবাদী বলে পরিচয়দানকারীদের একাংশও এই সমস্যা দ্বারা আচ্ছন্ন? এই সব প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে হবে ইতিহাসের আলোকে নারীবাদ এবং নারীবাদী আন্দোলনের দার্শনিক প্রবনতার মধ্যে।

আমাদের উপমহাদেশে এই প্রশ্নে চমৎকার আলোচনা করেছিলেন কমরেড অনুরাধা গান্ধী। ভারতের মাওবাদী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, যিনি ভারতের সবচেয়ে বড় নারী সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

আঠারো ও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে সামন্ত সমাজের ভাঙ্গনের মুখে পুঁজিবাদের উত্থানের কালে ইউরোপে নারীবাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটে। মূলত এই সময়েই অধিকার রক্ষায় নারীরা নিজেরা রাস্তায় নেমে আসে। মার্কিন উচ্চবিত্ত শিক্ষিত নারীরা উদারনৈতিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নারীদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হন। তারা নারীর ভোটাধিকারসহ অন্যান্য দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলন মূলত নারীবাদী আন্দোলন হলেও প্রথম দিকে নারীদের এই আন্দোলনের কোন দার্শনিক ভিত্তি ছিল না। এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে দেখা যায় যে, প্রথম যুগের নারীবাদীরা সামন্তবাদের গর্ভে জন্ম নেয়া শোষণ, যা পুঁজিবাদের মধ্যে থেকে গিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে লড়াই করেন। কিন্তু তারা সংকীর্ণ দৃষ্টিতে তাদের আন্দোলন পরিচালনা করেন। এই সময়ের নারীবাদীরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে ভুগেছিলেন। তারা রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ ভেবে নিয়ে শুধু রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাতেন এবং আপোষ রফার পথ খুঁজতে থাকেন। এর ফলে এই আন্দোলন খুব বেশি দূর এগোয় নি। কিন্তু মার্কিন নারীরা ভোটাধিকার পান ১৯২০ সালে।

নারীবাদী আন্দোলনে সবচেয়ে বড় ধারা হলো র‍্যাডিকেল নারীবাদী ধারা। এই ধারা বিকাশ লাভ করে গত শতাব্দীতে।মূলত এনারা উদারনৈতিক নারীবাদীদের থেকে পৃথক। এরা শুধু দাবি দাওয়াতে সীমাবদ্ধ থাকেন নি। তারা সমাজের বিশ্লেষণের দিকেও গভীর মনোযোগ দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষাব্দি সমাজ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তারা শুধুমাত্র নারীকেন্দ্রীক বিষয়ে নিজেদের দৃষ্টি স্থির করে রেখেছেন। তারা নারীর বৈশিষ্ট্যকে বিশেষ করে দেখতে গিয়ে নারীকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। এনারা নারীকে যৌনতার ভিত্তিতে আলাদা করে নারীদের আলাদা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ার জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু সমাজ বিকাশের কোন স্তরে নারীরা নিপীড়িত হচ্ছে আর তার সাথে পুঁজিবাদের সম্পর্ক কী এই বিষয়গুলোকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে ব্যর্থ হন। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজের বুদ্ধিজীবী একটি অংশ। যার দরুন তারা  নিজ অজান্তেই শ্রেণি সম্পর্কে তাদের ধারণা অস্পষ্ট রেখেছেন। এজন্য তারা ব্যাপক শ্রমজীবী নারীকে অধিকার আন্দোলনে যুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

নৈরাজ্যবাদী নারীবাদীরা, নারীবাদী আন্দোলনে দার্শনিক প্রবণতাসহ যুক্ত হন। এই নারীবাদীরা মূলত নৈরাজ্যবাদী দর্শনকে ধারন করে নারীবাদী আন্দোলনকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এই ধারার নেতৃত্ব দিয়েছেন এমা গোল্ডম্যান। যিনি বাকুনিন, ক্রপটকিনদের দর্শন চিন্তা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন। এই ধারার নারীবাদী সংগঠকরা নারীদের স্বাধীন স্বকীয় সংগঠন বা স্থানীয় উদ্যোগের পক্ষে বলতেন। তারা এই বলে মার্ক্সবাদীদের সমালোচনা করতেন যে একটা উচ্চ কাঠামো ধারনকারী আমলাতান্ত্রিক সংগঠন নারী বা সামাজিক-রাজনৈতিক মুক্তি দিতে পারে না। তাই সমাজের ভেতর থেকেই ছোট ছোট উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আন্দোলন চালাতে হবে। আর ছোট উদ্যোগকে দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করে অন্যদেরও আন্দোলনের যুক্ত করতে হবে। এই দিক দিয়ে সংগঠন এবং আন্দোলনের প্রকৃতিগত দিক থেকে নৈরাজ্যবাদীরা র‍্যাডিকেল নারীবাদীদের সাথে নৈকট্য লাভ করেন। তারাও শ্রেণি বিভাজিত সমাজকে শ্রেণি সাপেক্ষে বিবেচনা করেন না। এবং এই নিরিখে সর্বহারা ও শ্রমজীবী নারীদের  প্রশ্নে সামগ্রিক বিপ্লবী কর্মসূচি হাজির করতে তারা ব্যর্থ হন।

গত শতকের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত পরিবেশবাদী নারীবাদের একটি ধারা বিকশিত হয়। এই ধারাটি মূলত র‍্যাডিকেল ধারারই একটি উপধারা। যারা প্রকৃতিকে ভিত্তি ধরে আলোচনা উত্থাপন করেন এবং প্রকৃতির সাথে নারীর সম্পর্ক বিবেচনা করে নারী আন্দোলন এগিয়ে নিতে চেয়েছেন।

নারীবাদী আন্দোলনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ন ধারা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী ধারা। এই অংশটি মনে করে যে সমাজ বিকাশের নিয়ম ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদ যুক্তিযুক্ত কিন্তু মার্ক্সবাদীরা মূলত উৎপাদন নিয়ে আলোচনা কেন্দ্রীভূত করলেও প্রজনন নিয়ে তেমন কথা বলেন না। তারা মনে করতেন সমাজ বিকাশে শুধু উৎপাদন নয় প্রজনন গুরুত্বপূর্ণ। আর প্রজননের ক্ষেত্রে নারীর সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। তাই তারা সমাজতান্ত্রিকদের থেকে পৃথক আন্দোলন গড়ে তুলবার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে এই ধারা থেকে আরেকটি উপধারা তৈরি হয় যারা মার্ক্সবাদ দ্বারা নারী সমস্যাকে সমাধান করবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাদের নিজস্ব শ্রেণি দুর্বলতার দরুন ব্যর্থ হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই ফ্রয়েড দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

সর্বশেষ নারীবাদী আন্দোলনে আরেক ধারা যুক্ত হয়। এরা হলেন উত্তরাধুনিক নারীবাদের ধারক। এই নারীবাদীরা মনে করতেন সকল নারীই আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারন করে অর্থাৎ এখানে সমষ্টিগত সাধারণ কোন ব্যাপার নেই। একজন শ্রমিক নারী শ্রমিক হিসেবে ইউনিক, একজন উচ্চবিত্ত সেও ইউনিক, একজন শিক্ষক সেও ইউনিক। এভাবে এই গোষ্ঠী নারীদের মধ্যে সাধারণ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেন এবং সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের নামে সামষ্টিক লড়াই কে বাতিল করে দেয়।

উপরে আলোচিত সবকটি ধারা সম্পর্কে খুবই সংক্ষেপে আলোচনার ফলে তাদের বিষয়ে শুধু মূল্যায়ন করা হয়েছে।কিন্তু আমাদের আরো বিস্তৃত মূল্যায়ন করার স্বার্থে নারীবাদের দর্শনগুলোকে অধ্যয়ন করতে হবে। যদিও আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার দরুন এখানে নারীবাদী আন্দোলন বিকশিত হবার সুযোগ খুব কম। কিন্তু আমাদের অনেক বন্ধুই যারা শহুরে মধ্যবিত্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন ও পড়ান, তারা নারীবাদী আন্দোলন দ্বারা আকৃষ্ট হচ্ছেন বা হবেন। সুতরাং মার্ক্সবাদীদের এই সম্পর্কে যথেষ্ট বিস্তারিত ধারনা থাকতে হবে।

নারীবাদী আন্দোলনের সব কটি ধারাই শ্রেণি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা সামগ্রিকভাবে নারী মুক্তির বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হন নি। ফলে তাদের ইতিবাচক লড়াই খুব ফল দেয় নি। বরং সমাজের ব্যাপক নিপীড়িত নারীদের থেকে তারা বিচ্ছিন্ন থেকেছেন চিরকাল।

আমাদের দেশে নারীবাদী আন্দোলনের সূচনা অনেক আগেই বলা যায়। সেক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া হলেন গ্রামীণ সমাজে উদার সমানাধিকারে বিশ্বাসী আন্দোলনের সংগঠক। তিনিই এই দেশে সর্বাধিক নারীদের পক্ষে আন্দোলন করেছেন। কিন্তু তার দৃষ্টিতেও সামগ্রিক নারী মুক্তি আসে নি। অন্যদিকে গত শতাব্দীর শেষ দিক থেকে যে নারীবাদী আন্দোলন এখানে শুধুই নারীবাদী আন্দোলন হিসেবে প্রচারিত হচ্ছে তা মূলত উপরিউক্ত দার্শনিক প্রবণতাগুলোর মিশেল। এখানে এজন্যেই দেখবেন নারীবাদীদের অনেকেই শাসকদের পা চাটেন। কারণ তারা মনে করেন যে শাসকরা কিছু নীতি শুধরে দিলেই নারীরা মুক্ত হবে। অন্যদিকে আরেক অংশ যারা নিজেদের র‍্যাডিকেল ভাবেন।যার মধ্যে আমাদের অনেক আন্তরিক বন্ধু রয়েছেন তারাও শ্রেণি প্রশ্নকে সঠিকভাবে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর ফলে তারাও থাকছেন বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রীক এক নির্দিষ্ট গণ্ডিতে। আবার রমনা/শিল্পকলা কেন্দ্রীক এস্থেটিক নারীবাদীরা মূলত নারীদের আলাদা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ধারন করার কথা বলে পুঁজিবাদের পণ্য অর্থনীতির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।নারীর স্বাধীনতার ধুয়ো তুলে পুঁজিবাদী পণ্য পর্ণোগ্রাফি থেকে শুরু করে ফর্সা হবার প্রসাধনীর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, যা তাদের শ্রমজীবী এবং সামন্তবাদ দ্বারা শোষিত নারীদের থেকে পৃথক করে দিয়েছে।

আমরা মার্ক্সবাদীরা মনে করি এ পর্যন্ত প্রত্যেকটি সমাজেই নারীকে শোষণের জন্য পুরুষতন্ত্রের নানা রূপ শাসকদের সেবা করেছে। কিন্তু এই পুরুষতন্ত্র কখনোই সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়ানো রাজনৈতিক ব্যবস্থার মুখোমুখি বা প্যারালাল কিছু নয়। বরং সামগ্রিক নারীমুক্তি আসতে পারে সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন করে সমাজতন্ত্র-কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কিন্তু তা বলে কি এখন নারীর উপর নিপীড়ণ এর জন্য সবাই বসে থাকবেন? অবশ্যই না। বরং দীর্ঘকাল জুড়ে নারীদের আলাদা সংগঠনের প্রয়োজন হবে। তারা নিজেদের অধিকার নিজেরা আদায় করার জন্য সংগ্রাম করবেন, যেখানে পুরুষ বন্ধুরা পাশে থাকবেন। আবার এই আন্দোলন হবে সামগ্রিক সমাজ বদলের আন্দোলনের অংশ হিসেবে, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়।

 

আতিফ অনিক: সভাপতি, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন