September 20, 2024
সম্পাদকীয়

করোনামুক্ত নতুন বিশ্বে জেসিন্ডারাই নেতা

শারমিন শামস্।। দেশকে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পেরেছে নিউজিল্যান্ড। এপ্রিলের শেষ সপ্তায় নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেন ঘোষণা দিয়েছেন, তার দেশ করোনামুক্ত হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে লকডাউন শিথিলও করা হবে। শুরু হবে সরকারি কাজকর্ম, সবাইকেই মেনে চলতে হবে সামাজিক দূরত্ব, যথেষ্ট সাবধান হয়ে চলতে হবে।

করোনা মোকাবেলায় নিউজিল্যান্ডের এই সাফল্যকে জেসিন্ডার নেতৃত্বাধীন সরকারের সাফল্য বলেই মনে করা হচ্ছে।  করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়ানোর প্রথম দিন থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছিল দেশটিতে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সব। বর্ডার সিল করে দেয়া হয়েছিল। একইসাথে চলছিল পরীক্ষা ও আইসোলেশন। তাই নিউজিল্যান্ডে আক্রান্ত ১৪২৭ জন আর মৃতের সংখ্যা ১৯-এ এসে থেমে গেছে। এরপরও নিউজিল্যান্ডের সীমান্ত দীর্ঘদিনের জন্য উন্মুক্ত করা হবে না। যতদিন মহামারির প্রকোপ না কমে, ততদিন বাকি বিশ্বের সঙ্গে এর সীমান্ত বন্ধ থাকবে।

এ তো গেল করোনা মোকাবেলায় জেসিন্ডার নেয়া তৎপরতার কথা। করোনাকে সাফল্যের সাথে বিতাড়িত করে এখন করোনাপরবর্তী সময় নিয়ে কী ভাবছেন জেসিন্ডা? তার সরকার?

লকডাউনের কারণে প্রতিটা দেশই বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের বাঘা বাঘা রাষ্ট্রগুলোর কপালেও চিন্তার বলিরেখা। এই বিশাল অর্থনৈতিক মন্দা সামাল দেবেন কীভাবে? কী করে আবার বাড়াবেন উৎপাদন, জাতীয় আয়! ঠিক এই জায়গাটিতে এসে জেসিন্ডা কী ভাবছেন?

ঠিক এই সময়টিতে নিউজিল্যান্ড সরকার এমন এক বাজেটের কথা বলছেন, যেখানে উৎপাদন বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, গুরুত্ব পাচ্ছে জনকল্যাণ।

পুরো বিশ্বই চরম পুঁজিবাদী হয়ে উঠেছিল, নাগরিকের স্বাস্থ্য, প্রাণ প্রকৃতির মঙ্গলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্রমাগত  পরিবেশবিরোধী কাজ করে গেছে বড় বড় রাষ্ট্রগুলো। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে কাড়ি কাড়ি টাকা আয় হয়ে উঠছিল মূখ্য, ব্যাক্তিজীবনের সুখ ও শান্তিকে তুচ্ছ করে দেখাই ছিল এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর মূল দর্শন।  করোনাভাইরাসের মহামারী মোকাবেলায় হিমমিম অবস্থা, চিকিৎসা পাওয়া না পাওয়ার বাস্তবতা এবং ভাইরাস থেকে বাঁচতে দীর্ঘসময়ের লকডাউন প্রতিটা রাষ্ট্রকে মুখোমুখি করেছে সেই সত্যের, যে সত্য নগ্ন করে দেখিয়ে দিয়েছে প্রতিটি রাষ্ট্রের এই পুঁজিবাদী চরিত্র এবং মানুষের প্রতি এর অশ্লীল বর্বরতাকে। অথচ এই পুঁজিবাদকেই সভ্যতা বলে চেনানো হয় আমাদের!

বলছিলাম জেসিন্ডার কথা। নিউজিল্যান্ড সরকারের কথা। নিউজিল্যান্ড সরকার করোনা পরবর্তী সময় নিয়ে ভাবছে। তারা এবার এমন একটি রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগী হবে যে রাষ্ট্র হবে আরো বেশি জনকল্যানমুখী, সমতাপূর্ণ; যে রাষ্ট্রে সাংস্কৃতিক বন্ধন ও জনসংযোগকে গুরুত্ব দেয়া হবে। এরই মধ্যে জেসিন্ডা সরকার দুইশ মিলিয়ন ডলার আলাদা করে রাখছেন পারিবারিক ও যৌন সহিংসতার শিকার মানুষের পূনর্বাসনের জন্য, সেই সাথে দেশটির গৃহহীন মানুষকে ঘর দেবার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন এই প্রধানমন্ত্রী। তার নেয়া পরিকল্পনা নীতির মধ্যে রয়েছে সাধারণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, শিশুদের দরিদ্রতা দূর করা, মানুষে মানুষে যে অসাম্য অবস্থা রয়েছে তা দূর করা, ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করা এবং পরিবেশ দূষণের মাত্রা যতটা সম্ভব কম রেখে  এক টেকসই অর্থনীতি তৈরিতে কাজ করা।

পৃথিবীর আর কোন দেশ এই করোনা মুহুর্তে নাগরিকের মানসিক স্বাস্থ্য, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও  সমতার কথা এতটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে কি না, আমার জানা নেই। জেসিন্ডার সরকার ভাবছে। তথাকথিত উন্নয়নের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন জেসিন্ডা আসলে। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন পুঁজিবাদের প্রতি। তবে খুব শান্ত আর বিনয়ী ভঙ্গিতে।
প্রকৃত নেতার বৈশিষ্ঠ্যই তো তাই। ৩৯ বছর বয়সী একজন সংবেদনশীল বুদ্ধিমতী নারী, একজন প্রতিভাবান  রাজনীতিবিদ ও এক সফল রাষ্ট্রনায়ক জেসিন্ডা আর্ডেন।

মানুষের উন্নয়ন যে প্রাণপ্রকৃতিকে সাথে নিয়ে তা অনুভব করেছেন জেসিন্ডা, তার সরকার। মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যই যে সব সুখের মূল, সেটি তার উপলব্ধিতে রয়েছে। যেখানে উন্নয়ন আর জৌলুসের ছড়াছড়ি থাকা সত্ত্বেও করোনার কাছে মার খেয়ে গেছে আমেরিকার মত ঝকমকে রাষ্ট্রটি। জেসিন্ডা জানেন, একটি সুস্থ জাতি তৈরিতে জনমানুষের মনের সুস্থতা, শান্তি ও কল্যাণই আসল কথা। বড় বড় রাস্তা, ফ্লাইওভার, যুদ্ধাস্ত্র, পারমানবিক বোমা কিংবা মহাকাশ দখল নয়।

জেসিন্ডা হলেন ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সেই নেতা, যার হাত দিয়ে পৃথিবী নতুন করে বেঁচে উঠবে। যে নেতারা জেসিন্ডার মত করে ভাবতে পারবেন, অনুভব করতে পারবেন, উদ্যোগী হতে পারবেন, নতুন পৃথিবী তাদেরকেই স্বাগত জানাবে। আর যারা এরপরেও লোভের সমুদ্রে খাবি খাবে, দেশে দেশে মোড়লগিরির পায়তারা করবে, অন্যের সম্পদে হাত বাড়াবে, যুদ্ধ করে মানুষ হত্যা করবে, তারা নিঃশেষ হয়ে যাবে। ইতিহাস তাই বলে। আর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, এ তো আমরা সকলেই জানি।