সন্তান মানেই টাকা রোজগারের মেশিন নয়
পিকলু প্রিয়।। ছোট বেলায় শুনতাম ‘সুদখোর’ মানে মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার নিলে যার বিনিময়ে অতিরিক্ত টাকা দিতে হত। এবং বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত টাকা দিতে হলে সেটাকেও সুদ বলা হত! সময়ের বিবর্তনে সবকিছুই পাল্টায় এবং সেটা স্বাভাবিক, তাই এখন আর সুদ শব্দটির কথা শুনি না। তার মানে এই নয় সুদ শব্দটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে! সেটা এখন নতুন মোড়কে ঘুষ নামক শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে!
মানুষ ব্যাংকে টাকা বিনিয়োগ করার কারণ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা ও টুকটাক সমস্যার সমাধান করা ইত্যাদি।
ঠিক তেমনি প্রায়শই পিতা মাতা সন্তান জন্ম দেন তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা, বংশবিস্তার করা ও বৃদ্ধ বয়সে তাদের দেখাশুনা করার জন্য। আমি মনে করি বৃদ্ধ বয়সে মাতা পিতাকে অবহেলা করা কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে রাখা যতটুকু পাপ ঠিক ততটুকুই পাপ পিতা মাতারা যখন সন্তানের প্রাণবন্ত জীবনটাকে পণ্য মনে করেন। যদিও এই রকম পন্যবাজ পিতা মাতার সংখ্যা অনেকাংশ কমে এসেছে।
এইবার আসেন যে সত্য সচরাচর বলা হয় না, রীতিমত মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়, সেটা নিয়ে কিছু আলাপ করি। এখন মিডিয়ার যুগ পত্রিকা, অনলাইন পোর্টাল, ফেইসবুক ইত্যাদিতে পিতা মাতাকে সন্তান দেখাশুনা করে না এই ধরণের নিউজ প্রায়’ই ভাইরাল হয়, নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। আমিও সেগুলোর তীব্র নিন্দা জানাই এবং মন থেকে ঘৃণা করি। যে পিতা মাতার সীমাহীন শ্রম আর অগনতি কষ্টের ফলে পৃথিবীতে আগমন, তাদেরকে অবহেলা করা! এর থেকে বড় কোন পাপ আছে বলে আমার জানা নেই।
কিন্তু এ দুনিয়ায় এমন পিতা মাতাও আছেন, যাদের নীরব মানসিক নির্যাতনে হাজার হাজার সন্তানের জীবন বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে! বাজে কথা, কটুক্তি আর শারীরিক মানসিক অত্যাচারে সন্তানের আত্মবিশ্বাস, মানসিক শক্তি, ভবিষ্যত ইত্যাদি নষ্ট করে দেওয়ার হাজার ঘটনা আমরাও কম বেশি সবাই জানি এবং শুনি। কিন্তু কেউ তা প্রচার করি না। কারণ সব পিতা মাতার বক্তব্য উনারা সন্তানের মঙ্গলের জন্য এগুলো করে থাকেন। ধরা যাক ভালোর জন্যই করেন কিন্তু উনারা কি জানতে চান সন্তান কীভাবে ভাল থাকতে চায়? মোদ্দা কথা পিতা মাতারা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সন্তানদের ভালো মন্দের বিচার করেন সন্তানদের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়!
স্বামী স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উঠলে অনেকেই মুখ খোলেন এবং প্রচার করেন। কিন্তু কোন সন্তান’কে দেখিনি পিতা মাতার অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে। তারা নীরবে নিভৃতে সহ্য করে যায়, কাউকে দেখিনি এই নিয়ে এক কলম আজ পর্যন্ত লিখেছে বা প্রচার করেছে। আর যদি বাস্তব জীবনে কেউ করেও থাকেন তা হলে সেটা আমার নজরে আজ অবধি আসেনি। সত্যি কিছু কষ্ট মানুষ কেবল খুব নীরবে সহ্য করে যায়। কিছু কষ্ট কাউকে বলা যায় না, খুব কাছের মানুষকেও না।
দয়া করে আপনারা যারা পিতা মাতা হয়েছেন সন্তানের প্রতি একটু সদয় হবেন। আপনার সন্তান কেবল আপনার টাকা রোজগারের মেশিন নয়। তারও একটা মন আছে, তারও একটা স্বপ্ন আছে, তারও দুঃখ কষ্ট হয়, তার ইচ্ছে হয় নিজের মত করে বাঁচতে, দয়া করে বুঝতে চেষ্টা করুন। হাজার হাজার সন্তান কেবল তাদের পিতা মাতার কারণে আজ সম্ভাবনা আর যোগ্যতা থাকার পরেও জীবন থেকে ছিটকে গিয়েছে এবং যাচ্ছে। যারা আজ জীবনে ব্যর্থ বা কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায়নি, খোঁজ নিয়ে দেখবেন তাদের অনেকের জীবনে এমন কিছু ইতিহাস আছে। শুধুমাত্র পিতা মাতার মুখের দিকে তাকিয়ে সন্তানরা নীরবে হাজার হাজার বার মরে যাচ্ছে। সন্তান জন্ম দিয়েছেন বলে তাকে মানসিকভাবে হত্যা করার অধিকার কোন জন্মদাতার থাকে না। থাকে কি?
অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা একে অপরকে ভালোবাসে, এক সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটানোর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু পিতা মাতারা সন্তানদের স্বপ্নকে কবর দিয়ে তাদের পছন্দমত বিয়ে দেন। এখানেই তো আপনার জীবিত সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনকে গলা টিপে হত্যা করে দিলেন! মরে মরে বেঁচে থাকে তারা একমাত্র পিতার মাতার কথা চিন্তা করে।
মানব সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে পাঠ্যপুস্তক খানিকটা পড়েছি। আচ্ছা ধরে নিন আমি পাঠ্যপুস্তক তেমন পড়ি নাই, ইতিহাসও তেমন একটা জানি না। তবে নিজের ২৪ বছর বয়সের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে বলছি অনেক পরিবারকে দেখেছি মেয়ে সন্তান জন্ম হলে পিতাসহ পরিবারের সবাই তেমন একটা খুশি হতেন না, কারণ মেয়ে জন্ম নিলে’তো রোজগার হবে না বরং ভরণপোষণ করে এক সময় বিয়ে দিতে হ, তখনও টাকার ব্যয়!
আমরা চার ভাই, বোন নেই। অনেকেই বলতেন তোমার তো বোন নেই, কোন চিন্তা নেই। পিতা মাতাকে বলতেন, তোমাদের তো মেয়ে নেই, বিয়ের খরচ থেকে বেঁচে গেলে।
এই ধরণের কথাগুলো যখন শুনতাম তখন খুব অবাক হতাম আর মনে মনে ভাবতাম এরা এতটাই কম শিক্ষিত, এতটাই অমানবিক, লেখাপড়ার বালাই কি তাদের মধ্যে একদম নেই! নাকি কয়েকটা সার্টিফিকেট আর একটি চাকুরি পর্যন্তই তাদের লেখাপড়া সীমাবদ্ধ!
সিমোন দ্য বোভোয়ার বলেছিলেন “কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে নারী’। তবে বর্তমানে সমাজের টাবু ভেঙ্গে অনেকটাই এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। তারা এখন আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজেদেরকে সন্তান জন্ম দেওয়ার মেশিন ভাবে না, পুরুষতান্ত্রিক প্রথার দাসি ভাবে না। তারা এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজেদের অধিকার নিয়ে বাঁচতে শিখেছে। সারা বিশ্বে এখন পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে নারীরাও কাজ করে যাচ্ছে। তবে বাস্তবে নারীদের যাপিত জীবনে এখনো রয়েছে পুরুষতন্ত্রের অনেক প্রভাব। তারপরও আমি স্বপ্ন দেখি নারী পুরুষ মিলে এই পৃথিবীটা একদিন মানুষের হবে। মেয়ে সন্তান জন্মালে কোন পিতা মাতা তাকে বোঝা মনে করবে না। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি নারীবাদের মূলমন্ত্র ‘শুদ্ধতম মানুষ হওয়া’।
পৃথিবীতে যখন কৃষি বিপ্লব শুরু হয় তখন মানুষ টিকে থাকার স্বার্থে প্রথম শ্রমিকের উপযোগিতা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তারপর উনারা অবিষ্কার করেন একজন পুরুষ যদি জমিতে লাঙ্গল দেন এবং একজন নারী যদি গণ্ডা গণ্ডা সন্তান জন্ম দিয়ে লাঙ্গল দেওয়ার মত শ্রমিক তৈরি করতে পারেন, তা হলে হয়তো সব থেকে বেশি ফসল উদ্বৃত্ত থাকে। এইটা একদিনে হয় নাই, এই ঘটনা ঘটতে কয়েক হাজার বছর সময় লেগেছে।
পরিশেষে বলছি, পৃথিবীর সকল পিতা মাতাকে আমি ঈশ্বরের থেকে বড় মনে করি। পৃথিবীর সকল পিতা মাতাদের প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জ্ঞাপন করে বলছি, দয়া করে আপনারা মেয়ে জন্ম নিলেই তার ভরণপোষণ করে বিয়ে দেওয়া, আর ছেলে জন্ম নিলে টাকা রোজগারের মেশিন ভাববেন না। ছেলে হউক মেয়ে হউক প্রথমে তাদেরকে মানুষ হতে সহযোগিতা করুন। তাদেরকে শুদ্ধতম মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন। তারপর দেখবেন তারা নিজ থেকে নিজেদের তাগিদে, জীবনের তাগিদে জীবিকা নির্বাহ করবে, সংসার করবে, নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি করবে। পিতা মাতাকে ঈশ্বরের উর্ধ্বে ভাববে। জোর করে তাদেরকে আপনার অনুগত থাকতে বাধ্য করবেন না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]