চাই নিজের টাকা, আত্মবিশ্বাস আর মনোবল
সাদিয়া মেহজাবিন।। ঘটনার ঘনঘটা। বেশ! আজকাল সবকিছুই রমরমা। আমাদের দেখা অনেক কিছুই আমরা আমাদের নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে পছন্দ করি। কিছুর ফসল ভালো আর কিছুর ফসল খারাপ। আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে দেখা বেশিরভাগই আমরা প্রয়োগ করে ফেলেছি বলতে পারেন। কেবল নারী বলে তাকে নিয়ে লেখা হচ্ছে এমন যারা ভাবছেন তাদের জন্য হয়তো বা অনেক লিখে ফেললেও হবেনা। তাদেরকে আমার বোঝাতে ইচ্ছে করে না কেন অনেকেই নারীদের নিয়ে এত লেখেন। তা আমাদের জীবনের ঘটনা দেখলে, আমাদের উপর হওয়া অন্যায় অত্যাচার, আমাদের প্রতি ন্যায় বিচারের অভাব, দৈনিক দিনলিপি, পুরুষের সাথে মেয়েদের অসমতা, সমাজে মেয়েদের অবস্থান এসব দেখলেই বুঝে যাবেন। তার জন্য আমার কিংবা অন্য একজনের মস্ত বড় লেখা না পড়লেও চলে।
কিছু ঘটনা আমার মাথায় বেশ কড়া নাড়ে। আমি ভাবতে থাকি। হিসেব মেলানোর চেষ্টা আমাকে ঘুমাতে দেয় না। সব কিছু কেন এই শতকে এসেও এমন তা ভাবতে থাকি। কোথায় যেন পড়েছিলাম একজন লেখক তার জীবনে কেবল আত্মজীবনী লেখে যান। আসলে লেখক যা দেখেন তা তার নিজের ভাষায় তুলে ধরেন। আমার দেখা এমন কিছু ঘটনা আমাকে আসলেই ভিতরে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন করে আর নিজেকে নিজের অবস্থান নিয়ে ভাবতে শেখায়।
আমাদের পাশের বাড়িরই দুই ভাবি। একজন চাকরি করেন, আরেকজন গৃহিণী। সবসময় দেখি গৃহিণী ভাবির ঘরে কিছুনা কিছু ঝগড়া লেগেই থাকে। ভাবির স্বামী কেন রাত করে ফেরেন, কেন অন্য মহিলাদের সাথে তার এত খাতির, কেন তিনি আমাকে কিংবা অন্য মেয়েদের খারাপ ভাবে দেখেন, কেন ভাবিকে মারেন- এমন প্রশ্ন করার অধিকার তার নেই। ভাবি লেখাপড়া তেমন করেননি। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা তার নেই। ভাইয়া তাকে বের করে দিলে যাবার কোনো জায়গা নেই। ফলে প্রশ্ন করার অধিকার তার নেই। তখন আমার মনে হয়, আসলে আপনার সঙ্গী সম্পর্কে জানার বা প্রশ্ন করার অধিকার বুঝি সচ্ছলতার উপর নির্ভর করে।
এখন তাকাই চাকুরি করে যে ভাবি, তার দিকে। এ ভাবির অবশ্য অনেক সচ্ছলতা আছে কিন্তু সুখ নেই। কেননা স্বামী যেভাবে মারেন সেভাবে সুখ না খুঁজে বেঁচে ফেরা অনেক। ভাবি চাইলে পারেন এসব ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু পারেন না বাচ্চাদের জন্য। তখন আমি ভেবে দেখি, আসলে বাচ্চাগুলোকে ভাবি একলাই অনেক ভালো মানুষ করতে পারতেন! কিন্তু তিনি ভয় পান এ সমাজকে। যে সমাজ একটা একলা মহিলাকে মেনে নেয় না। যে সমাজে একলা মহিলা দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিনে নেয়া পণ্যের মত ভোগ করতে চায়। মা বাবা সবাই তখন বোঝা মনে করে।
আপনার থাকতে পারে কাড়ি কাড়ি টাকা, কিন্তু আপনার অবশ্যই থাকতে হবে সাথে একটা স্বামী। যেমন কোন পোষা প্রাণির পাশেই তার মুনিব থাকা চাই, তেমন। যেমন রাজার দরবারে রাণি। আপনি নিজের ক্ষমতা গুনে রাণি হলেও আপনার থাকা চাই একটা স্বামী। নাহলে আপনাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে আবর্জনার মত।
আমার নিজের ঘরকে আমি বাদ দিই না কখনোই। আমাদের বেশি বোন হওয়াতে দ্রুত আপদ বিদায় হওয়ার একটা ব্যাপার ছিল। দ্রুত বিয়ে হয়ে চলে যাও। এভাবে এত ময়লা ঘরে রাখা যায় নাহ! কিন্তু আমার আপুরা খুব ভালো বুঝে গেছে কী করলে মুক্ত পাখির মত ডানা মেলা যায়।তাই পড়ালেখা করে নিজের সচ্ছলতা নিজেরা করল। নিজেদের উপার্জন দিয়ে এখন আমাদেরকেও সাহায্য করে। আগে এই মেয়েদেরই পান থেকে চুন খসলে অনেক কথা হত। এখন তাদেরকে কিছু বলার সাহস কেউ পায়না। কেননা তাদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আছে। মনের মুক্তিও ঘটেছে। তারা সাহসী, আত্মবিশ্বাসী। এসব যদি থাকে, তাহলে আপনি সিগারেট খান আর নিজের পছন্দ অনুসারে বিয়ে করেন কিংবা যখন খুশি বেড়াতে যান কিংবা যখন খুশি নিজের মত করে থাকেন কেউ কিছু বলবেনা।
আমার বান্ধবী। বয়স খুব বেশি হয়নি। কিশোর বয়স উথাল পাথাল প্রেমে পড়ার সময়। একদিন মা বাবার হাতে ধরা খেয়ে অসম্ভব মার খেয়ে আমার কাছে এসে ভীষণ কেঁদেছে। আমি অবাক হয়ে বললাম “কিরে ওইদিন তোর ভাইকে দেখলাম এক মেয়েকে নিয়ে আমাদের উপরের ব্যাচেলর বাসায় লুকিয়ে নিয়ে গেল। তোর আব্বা আম্মা দেখেনা এসব?”
আমি সিগারেট খাব। খেতে চাই। আমার ভালো লাগে তাই। আমি খাই। এখন আমার নিজের পয়সায় খাই। আম্মা একদিন দেখে ফেললেন ব্যাগে। তা দেখে এক রমরমা ঘটনা হয়ে গেল বাসায়।মানসম্মত অপমান করেও নিস্তার নেই, বাইরে ফেলে দেওয়া হল। তখন কাঁদতে বসে বসে ভাবলাম ভাইয়া মেয়েঘটিত মামলা, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মামলায় অনেক আগেই নাম লিখিয়েছে যা বাসার সবাই জানে। আম্মা তো বলেই দিয়েছে “ছেলেদের এমন একটু ঘটনা থাকে। বাদ দাও এসব”। তখন আমি ভাবলাম ছেলেদের জন্য সাত খুন মাফ। আমি কিছু করলেই নন্দ ঘোষ।
অনেক বিশ্লেষণের পর বুঝেছি এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের নিয়মে বানানো। তাদের জন্য সব কিছু হালাল। তাই এত কিছু না ভেবে আমি যা ভাবলাম সব কিছু কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?
টাকাতে।
ভাবিদের স্বামীরা তাদের ঘরের অর্থনৈতিক কর্তা, আমার বান্ধবীদের বাসায় তার ভাই তাদের সবাইকে চালায় অর্থনৈতিক ভাবে, তাই সে সেখানে কর্তা। আমাদের বাসায় আমার ভাই সব, মরলেও সব বাঁচলেও সব। কেননা সে সব কিছু ‘রে আমাদের ঘরের প্রাণ বাঁচায় রাখছে।তার মানে আপনি কি এখন বিয়ে করবেন, নাকি প্রেম করবেন, নাকি তালাক দিয়ে চলে আসবেন, নাকি সিগারেট মদ খাবেন সব নির্ভর করতেছে আপনার সচ্ছলতার উপর। সাথে আপনি আদতে কত হেডাম দেখাইতে পারেন তার উপর। আপনার জোর, হাত, পা কত লম্বা।এসবের থেকেও যা বেশি আমি মনে করি আপনি কত বেশি মানসিকভাবে শক্ত। এখন যদি আপনি লাথিগুতা খেয়ে থাকতে চান তা আপনার নিতান্তই আপনার বিষয়। আপনার সচ্ছলতার জন্য বড় ডিগ্রি লাগবে তা না। অবশ্যই পড়ালেখা করার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু নিজেকে শেষ পর্যন্ত স্বনির্ভর আর সাবলম্বী করাটাই শেষ কথা। এখন আপনি যদি নিজেকে নায়িকা ভেবে নিজেকে ঘরের আদুরে হয়ে থাকেন, তাতে আপনার আত্মসম্মান তৈরি হবেনা কোনদিন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
আমাদের অবশ্যই আগে মানসিকভাবে দৃঢ় হতে হবে। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনতে হবে। আর নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে। নিজেকে ভালোবাসতে হবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]