আনিসুজ্জামানের বিপুলা আনন্দের পৃথিবী
মাসকাওয়াথ আহসান।। আনিসুজ্জামান স্যার চলে গেলেন; কলাভবনে ক্লাস নেয়া শেষে; খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে অপরাজেয় বাংলার পাশ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে যেন মেঘের দেশে ভেসে গেলেন; তারুণ্যে আমাদের সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের স্বপ্নবুননের জাদুকর। করোনাকাল আমাদের সোনালি যুগের মানুষদের কেড়ে নিয়ে এঁকে দিচ্ছে এক ধূসর সময় রেখা।
১৯৮৯ সালের কোন দুপুর; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টাল লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশ দিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে যেন এক ঝলক হেঁটে যেতে দেখলাম; খদ্দেরের পাঞ্জাবি পরা ষাটের কিংবা সত্তরের দশকের নায়ককে।
এরপর তাঁর সঙ্গে দেখা হলেই মনে হতো সাদাকালো চলচ্চিত্রের যুগে ফিরে গেছি। খদ্দরের পাঞ্জাবি-সাদা পাজামা আর গাঢ় বাদামি রঙের ফ্রেমের চশমা পরা সুদর্শন সে নায়ক। একদিন কলাভবনের বারান্দায় হেঁটে যেতে দেখে অনুসরণ করলাম; উনাকে আনিসুজ্জামান লেখা নেমপ্লেটের একটা কক্ষে ঢুকতে দেখে বুঝলাম; উনি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
আমার কল্পনার সাদাকালো যুগের নায়ক আর বাস্তবের আনিসুজ্জামান মিলিয়ে নিয়ে বেশ লাগতো উনার সঙ্গে দেখা হলে। কারণ একদিকে রঙ্গিন যুগের ছুটে চলা; অন্যদিকে সাদা-কালো যুগের নস্টালজিয়ার দোলাচলে; তিনি যেন মনের মাঝে বেজে চলা “শান্তি নাই শান্তি নাই” গান থামিয়ে দিয়ে আমার মনের মধ্যে বাজাতেন, “বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি ।”
একুশে বইমেলার সময় মেলায় প্রথম প্রবেশকারী কয়েকজনের মাঝে তিনি থাকতেন। বিভিন্ন স্টলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বই পড়তেন। পাবলিক লাইব্রেরিতে মুক্ত দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। দেখা হতো শিল্পকলা একাডেমিতে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীতে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না; কিন্তু উনি ছিলেন আমার শিক্ষকদের অনেকের শিক্ষক।
আমার জীবনে তিনি সোনালি যুগের বাংলাদেশ মনীষার প্রতীক। চোখের সামনে শহর বদলে যাচ্ছিলো; ফ্যাশান বদলে যাচ্ছিলো; কিন্তু সেই ষাট-সত্তর দশকের এনলাইটেনমেন্টের জীবন-চর্যা ধরে রেখেছিলেন তিনি। সুযোগ পেলে একুশে বইমেলা, জাতীয় জাদুঘর অডিটোরিয়ামে উনার উন্মুক্ত ক্লাস শুনতাম। নৈর্ব্যক্তিক-নান্দনিক অথচ ঋজু বাক্যের মধ্যে উনি যখন শব্দের অলংকার পরাতেন; মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গেলেও, “অপরাজেয় বাংলার পাশ দিয়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে আনিসুজ্জামানের হেঁটে যাওয়ার” চিত্রকল্পটি সিনেমাটোগ্রাফির মতো ভেসে ওঠে হারানো দিন পুরনো স্মৃতির কথা ভাবতেই।
এরপর কর্মজীবনে আবার শেরে বাংলা নগরের জাতীয় বেতার ভবনে আনিসুজ্জামান স্যারকে দেখে চমকে উঠলাম। শহরের বাছুর বুদ্ধিজীবীকে রেডিও-তে ডাকলে; “টিভি হইলে যাইতাম” বলে ভেংচি কাটতো; সেখানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এতো দূরে স্কুটারে চেপে এসে নামলেন। পোর্টিকোর পাশে বাগান জুড়ে বসন্তের হাওয়া দুলে উঠলো যেন।
সাদাকালো যুগের নায়ককে হাজির হতে দেখে কাজে উদ্দীপনা পেলাম। স্টুডিও-তে যখন উনার টক রেকর্ড হতো; তখন আবার সেই সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের নৈর্ব্যক্তিক বাক্যে এক একটা শব্দের অলংকার পরানোর সেই জাদু দেখতাম। বাংলা ভাষাকে নাচাতে জানলে সে যে “তা তা থৈ থৈ” করে নেচে উঠতে পারে; তা বুঝতে আর বাকি রইলো না।
দেশ ছাড়ার পর জার্মানি থেকে তাই স্যারকে ইন্টারভিউ নিয়ে বিরক্ত করতাম সময়ে-অসময়ে। কিন্তু বিরক্ত হবার মানুষ যে তিনি নন। বিশ্বজোড়া ছাত্ররা যার; তাঁকে ক্লাস তো নিতেই হবে দূরাভাসে। স্যারের ইন্টারভিউ এডিট করার প্রয়োজন নেই। কেননা পলিটিক্যালি কারেক্ট মানুষ তিনি; দ্বেষ নেই-প্রতিহিংসা নেই; এনলাইটেনমেন্টের বাহক তিনি।
অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে মানব সভ্যতার জন্য হিতকর কথা তিনি বলতেন। সেটা শুনে নানাজনের নানা প্রতিক্রিয়া হতো। সামাজিক বদ-অভ্যাসের কারণে অনেকে কর্কশভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতো। কিন্তু স্যার কখনো প্রতি প্রতিক্রিয়াতেই যাননি। তার জগতটা সোজা সাপটা।
স্যারের ছেলে আনন্দ জামান; পরে ফেসবুকে তার সঙ্গে পরিচয় হলো । সামাজিক বদ-অভ্যাসের কারণে আমি কখনো ফেসবুকে কোন প্রতি-প্রতিক্রিয়া দেখালে, আনন্দ ইনবক্সে এসে বলেন, এর কোন দরকার ছিলো না।
আনন্দের কারণে স্যারের সঙ্গে যোগাযোগটুকু ছিলো। ছাত্রজীবন তো নেই; তবু স্যারের কাছে আমার বাছাই লেখালেখি পরীক্ষার খাতা হিসেবে জমা দিতাম। স্যার পড়ে গ্রেড দিয়ে দিতেন। স্যার এমন অনেক ছাত্রের “যেমন ইচ্ছে লেখার খাতা” পড়েছেন; পরামর্শ দিয়েছেন; অকুন্ঠ প্রশংসায় অনুপ্রাণিত করেছেন।
বাংলাদেশ লেখক ও ব্লগারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায়; সব বুদ্ধিজীবীই যখন “কাফের ও মুরতাদ” ফতোয়ার ভয়ে অনুশীলিত নির্লিপ্ততায় ফুল গাছের পরিচর্যা করতে করতে ভাবছিলেন, “ঝিনুক নীরবে সহো”; একমাত্র আনিসুজ্জামানই তখন বললেন, ‘‘মানুষের বিশ্বাসের স্বাধীনতা যেমন আছে; তেমনি অবিশ্বাসের স্বাধীনতাও থাকতে হবে।”
এটাই হচ্ছে এনলাইটেনমেন্ট; গণতন্ত্রের অর্থ গভীরভাবে অনুধাবনের উচ্চারণ। স্যারের উচ্চারিত নৈর্ব্যক্তিক নিরপেক্ষ মানবিক এই বাক্যটি; মানুষের মুক্তির চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার দাবি তুলেছে।
যে মানুষটির শৈশব কেটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে; এরপর বাংলাদেশ বিভাগের যন্ত্রণা। কলকাতার নিশ্চিত জীবন ফেলে অনিশ্চিত খুলনায় চলে আসা; তারপর একটু বড় হলে মাতৃভাষা বাংলা কেড়ে নেয়ার হীন চেষ্টায় বেদনার্ত হওয়া; ৫২-র ভাষা আন্দোলনের সময় ১৫ বছর বয়সী আনিসুজ্জামান রচনা করেছিলেন একটি পুস্তিকা, ‘রাষ্ট্রভাষা কী ও কেন?’ তারপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো তারুণ্য; মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারে অংশগ্রহণ, দেশ স্বাধীন হলে সংবিধান প্রণয়নের কাজে অংশগ্রহণ; জাতির জনক হত্যার ট্রাজেডি; অ্যামেরিকান মডেলের পুঁজিবাদী রাষ্ট্র গড়ে ওঠার রাহুকাল; একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে নাগরিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ; এরপর আবার জিডিপি গ্রোথের উন্মাদনায় ফকির-দরবেশে ভরে ওঠা বাংলাদেশ; সবশেষে করোনাকালে মানবিক বিপর্যয়ের ট্র্যাজেডি দেখতে দেখতে; এই যে উনি চলে গেলেন; একজীবনে কতটা প্রাণপ্রবাহ থাকলে সোনালি যুগের মানুষেরা এতো কষ্ট সহিষ্ণু-সাধক হতে পারেন সেটা অপার বিস্ময়ে দেখি।
তবে আনিসুজ্জামান স্যারের একটা নিজস্ব আনন্দের জগত ছিলো; বইপড়া -গবেষণা করা-আড্ডা। এ আড্ডা আমার চিরচেনা পরচর্চা-পরনিন্দা নয়; এ আমাদের অপরিচিত প্রজ্ঞানন্দের আড্ডা। এইভাবে বিপুলা পৃথিবীর রহস্যের কূল কিনারা করার এক অধ্যবসায়ী অথচ রোমাঞ্চকর জীবন কাটালেন তিনি।
বাংলাদেশের সদা-সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলতেন, “প্রতিহিংসার মনোজগত থেকে মুক্তি ছাড়া এ সংঘাতের কোন শেষ হবে না।
মাসকাওয়াথ আহসান: শিক্ষক ও সাংবাদিক