November 2, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী

সানজিদা খানম ।। “আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী”- বহুল প্রচলিত এ প্রবাদ যতটা জনপ্রিয় ততটা যৌক্তিকও বিবেচনা করা হয়। এখানে যে দর্শন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা বাহ্যিক কাঠামো বা বলা ভালো বাহ্যিক সৌন্দর্যের দিকে ইঙ্গিত করে। যে জিনিস যতটা দৃষ্টিনন্দন তার প্রতি মানুষের প্রথমে আকর্ষণ জাগবে।

এখন আসি লিঙ্গ বিচারে এ প্রবাদটি কার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। একটা উদাহারণ দিয়ে শুরু করি।

আমি যখন হাইস্কুলে তখন দেখি আশেপাশের সব মেয়েরাই কেমন যেন পরিপাটি করে হালকা সেজেগুজে স্কুলে আসতে শুরু করল। স্কুল ছুটির সময় মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ে নিতেও ভুলত না। ঠিক একই বয়সী ছেলেরা তখন ক্রিকেট খেলে ঘেমে ভিজে উস্কখুস্ক চুল নিয়েই দিব্যি স্কুলে করছে। এটা তো গেল ছোটদের কথা, বয়স কম! কিন্তু বড়দের ক্ষেত্রেও যদি আসি একজন কর্মজীবী নারী তার কর্মক্ষেত্রে যাবার আগে কী পরবে তা নিয়ে যতটা চিন্তিত থাকে তার সিকি পরিমান চিন্তা কি একজন পুরুষ করেন? করেন না, কারণ একজন নারী নিজের অজান্তই এই প্রবাদের মূল মর্ম বয়ে বেড়াচ্ছেন, তিনি জানেন তাকে প্রথমে দেখা হবে অতঃপর গুণ বিচার করা হবে। এমনকি তার পোশাক দেখেই হয়ত বা তাকে প্রথম দফা বিচার বিবেচনা করা হয়ে যাবে।

পুরুষ যে এই প্রবাদের একদম বাইরে তাও বলা যাচ্ছে না, কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

আমার পরিচিত একজন শিল্পী আছেন যিনি দূর থেকে কারো কাগজের ওপর হাতের সঞ্চালন দেখে বলে দিতে পারেন ওই ব্যক্তির রেখার ওপর দক্ষতা কতটুকু। আমার পরিচিত বহু শিক্ষক আছেন যাঁরা শিক্ষার্থীর চোখ দেখলেই বলে দিতেন তার জ্ঞান পিপাসা কতটুকু। তারাও কিন্তু প্রথমে দেখতেন কিন্তু এই দেখা হাত কতুটুকু সুন্দর বা চোখ কতটুকু সুন্দর সেই দেখা না। ছোট থেকেই যখন কারো মগজে এই কথাটি ঢুকিয়ে দেওয়া হবে তখন সে চোখ দিয়ে শুধু বাহ্যিক দিকটাই দেখবে। তার ইন্দ্রিয় ‘গুণ’ বোঝার মত যোগ্যতা অর্জণ করবে কি? আমরা পাশাপাশি এ কথাও বলে থাকি “Don’t judge a book by its cover.”  আবার বলি “মনের সৌন্দর্যই বড় সৌন্দর্য” এবং আমার মতে এটা একটা গুণও বটে, কিন্তু যখনই প্রথমে দর্শনধারী করতে আমাদের অভ্যস্ত করা হচ্ছে তখন সেই মনের সৌন্দর্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা আমরা কতটুকু অর্জণ করতে পারব?

এটা যদি এমন ভেজাল মার্কা প্রবাদ হয়েই থাকে তবে এখন কথা হল এই প্রবাদটির অবতারণ করা জরুরি কেন হল?

এটাই একটা মজার বিষয়। পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সমাজে নারী হাজার বছর ধরেই দাসীর স্তরে থেকে এসেছে। তবে লোক দেখান কিছু সুযোগ সুবিধা তাদের দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এ সুযোগে যেন হাত ফসকে বেরিয়ে না যায় তাই সময়ে সময়ে রশি টানারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

যেমন নারীর রূপ নারী নিজে তার মত করে উপভোগ করার বা তার মত করে সাজাবার অধিকার রাখে না। এই প্রবাদটিই বড় একটি বাঁধা। এবং সেই সাথে এই প্রবাদটি বিশেষভাবে নারীদের ক্ষেত্রেই অধিক ব্যবহৃত হয়। তাই বাসা থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত তাকে তটস্থ থাকতে হবে তার রূপ নিয়ে। অন্য কেউ কিছু বলছে কি না। তার কাপড়চোপড় নিয়ে কোন কথা উঠছে কি না। এই সমাজে সে সবার দৃষ্টিনন্দিত কোন বস্তু হতে পারছে কি না! তাই তার মেকাপ, ফেয়ারনেস ক্রিম এবং সমাজের পছন্দসই কাপড়চোপড় পরা খুবই দরকারি। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সংজ্ঞানুযায়ী নারীর দৃষ্টিনন্দিত হওয়া জরুরি। নইলে যে অভিযোগ আর অপবাদের আঙ্গুল চরিত্র পর্যন্ত গড়াবে!

এ প্রবাদের আরো একটি বিশেষ দিক নিয়ে বলি। সমাজ চলতে ফিরতে এমন বহু প্রবাদ, বহু নিয়ম, বহু শৃঙ্খল অত্যন্ত গ্রহণযোগ্যভাবে সাজিয়ে আমাদের সামনে পেশ করেছে। যার ভেতরে ঢুকলেই বুঝবেন এটা আপনাকেেএকটা সীমারেখার মধ্যে আটকে রাখার জন্য একটা ফাঁদ ছাড়া আর কিছুই না। খুবই সূক্ষ্মভবে ছলাকলা সাজানো হয়েছে যেন আপনি ঠিক আগের মতোই শুধু তাদেরই সার্ভ করেন বরং সার্ভের গুণগতমান যেন আর বেশি হয়। মনে রাখা ভাল সমাজ ও রাষ্ট্র নীতিবাক্য বানায় তার সুবিধার্থে, আপনার আমার জন্যে না।

এখন বিষয়টা আপনার হাতে, আপনি প্রথমে দর্শনধারী হতে চান নাকি এই ফাঁদের মুখে ঝাঁটা মেরে নিজেকে মানুষের স্তরে আনতে চান!