মানবতার ধর্মে নজরুল
জায়েদ বিন আলী সুজন।। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য এক অধ্যায়। ২৫ মে তাঁর ১১৭তম জন্মবার্ষিকী। তাঁকে নিয়ে অনেকদিন থেকেই কিছু লেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু এটা তো অনেক সাহসের বিষয়। সে সাহস যে আমার নেই! অবশেষে প্রবল ইচ্ছের কাছে পরাজিত হল আমার সাহসের ঘাটতি। সেই ছোটবেলা থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রেম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছি তাকে। প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছিলাম আর সাথে সাথে বড় হচ্ছিল কবিকে নিয়ে বানানো আমার রাজত্ব। এর পেছনে যেমন তার অনবদ্য অসম্ভব সুন্দর সৃষ্টিগুলো ছিল তেমনি আরো একটি বিষয় বেশ বড় ভূমিকা রেখেছে। সেটি হলো তার ডাকনাম দুখু মিয়া। খুবই দরিদ্র পরিবারের বোঝা বহনকারী একজন ছিলেন তিনি।
আমি স্বপ্ন দেখতাম দুখু মিয়া হবার। কিন্তু তাঁর যোগ্যতার কানাকড়িও যে নেই নিজের মধ্যে। তবুও স্বপ্ন দেখেই যাই। এ জীবনে একটি দিন যেন তার মত বাঁচতে পারি। নজরুলের মতো হুট করে একদিন উধাও হয়ে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু পারি না। মুয়াজ্জিনের চাকরি ছেড়ে নাট্যদলে যোগদানের মতো মানসিক পরিবর্তন আনতে পারি না, নিজের মধ্যে। আমিও যদি পারতাম, নজরুলের মতো হুট করে সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যেতে। কিন্তু নজরুল তো একটা হয়েই গেছেন। আমার তো আর কিছু লেখার নাই। নজরুল সব লিখে গেছেন, কিছুই বাকি রাখেন নাই!
থাক, এসব অলীক কল্পনার কথা আর না বলি। এবারে বাস্তবে আসি। আমার দেশে আমার সমাজে বিদ্রোহী কবি আজ কোথায়? আমরা কি শিক্ষা নিয়েছি বা নিচ্ছি তার যাপিত জীবন থেকে! তিনি সারা জীবন গেয়ে গেছেন অসাম্প্রদায়িকতার গান। আমাদের জন্য তিনি রচনা করে গেছেন অনেক ইসলামিক গান, গজল। তার প্রতিটি গজল আমাদের মনকে শীতল করে। তার অননদ্য একটি গজল হচ্ছে-
“মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই”।
কিন্তু এটা মানে যে নজরুল ইসলাম শুধুই মুসলমানের, তা কিন্তু নয়। তিনি সকলের কবি। সবচেয়ে সত্য হল তিনি সুবিধাবাদী, লোভী একটি শ্রেণির ধর্মীয় অন্ধত্বের গোঁড়ায় বার বার কুঠারাঘাত করেছেন, ঘাট থেকে ঘাটে হন্যে হয়ে মানুষের মুক্তির পথ খুঁজে বেড়িয়েছেন। অথচ এই বঙ্গদেশে সেই নজরুলই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন শুধুমাত্র ইসলামিক কবি হিসেবে। তার মানে কি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য তাঁর সৃষ্টিকর্মগুলোকে অনাদর অযত্ন অবহেলায় ফেলে দেব? না, তিনি তা চান নি। আমাদের দেশের জীবন ব্যবস্থার সাথে ধর্ম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। সুতরাং এ সমাজে জন্ম নেয়া একজন কবি এটা নিয়ে লিখবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে কোন ধর্মের গন্ডির মধ্যে আটকে ফেলা হবে বোকামি। বোকামি তার সাথে আর একজন কবিকে জড়িয়ে বিভিন্ন অলীক গল্প বানানো। এতে তাঁর সম্মান বাড়ে না বরং কমে। এতে তাকে সম্মানিত করা হয় না, তাকে ছোট করা হয়। যেখানে তিনি নিজে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন সঞ্চিতা আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রিয় কবিকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন বসন্ত।
কাজী নজরুল ইসলামের স্ত্রীর নাম প্রমীলা দেবী এবং তিনি ধর্মান্তরিত হননি। কবির চার সন্তানের নাম- কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ। নামগুলো হিন্দু মুসলিম নামের সমন্বয়। আজকে নজরুল বেঁচে থাকলে হয়তো চাপাতির কোপে তার দ্বিখণ্ডিত মস্তক রাস্তায় পড়ে থাকত। তিনি যদি জানতেন হামদ-নাতের জোয়ারে তার রচিত অসংখ্য শ্যামা সঙ্গীত ও কীর্তণ বিস্মৃত হয়ে যাবে, তাহলে ৭২ সালেই রিটার্ন প্লেনের টিকেট কাটতেন। এমন পরিচয় তিনি নিশ্চয়ই চান নি, তা আমি হলপ করে বলে দিতে পারি।
কবি নজরুল তাঁর নিজস্বতায় উজ্জ্বল আছেন, থাকবেন। শুধু ভণ্ডরাই তাঁকে নিয়ে, তাঁর পরিচয় নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় অবিরত ব্যস্ত। জীবিত থাকতে তাঁকে যারা “যবন-কাফের” বলে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়েছিল, আজ তাঁরাই তাঁকে মহিমান্বিত করার চেষ্টায় রত। মুসলমানের ছেলে হয়ে হিন্দুদের নিয়ে লেখালেখি করার কারনে হিন্দুরা নজরুলকে “যবন” উপাধি দিয়েছিল আর হিন্দু মেয়ে বিয়ে করায় মুসলমানেরা তাঁকে “কাফের” বলেছিল। কিন্তু নজরুল মূলত কী ছিলেন? তিনি ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক চেতনা, যিনি বলে গিয়েছেন-
“হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই”।
তাঁর এ কথার ওজন ধারণ করার ক্ষমতা এই দেশের মানুষের নেই। মানবতার চেয়ে বড় কোন ধর্ম নেই। ধর্ম নিয়ে হানাহানি করা বোকামি, আত্মঘাতী এক খেলার নামান্তর মাত্র। তাইতো তিনি লিখেছেন-
“মানুষেরে ঘৃণা করি,
ও কারা, কোরান-বেদ-বাইবেল চুম্বিছে মরি-মরি?
ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে,
যেই মানুষেরা আনিল গ্রন্থ, সেই মানুষেরে মেরে।
পূজিছে গ্রন্থ, ভণ্ডের দল! মূর্খেরা সব শোনো-
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!”
কাজী নজরুল ইসলাম সবার। তাঁর চেতনায় যে বা যারা উদ্দীপ্ত, তিনি তাদেরই। শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]