November 2, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

পরকীয়া ও তৃতীয় পক্ষ

মেহেরুন নূর রহমান।। সম্প্রতি একজন সুপরিচিত নারীর বিরুদ্ধে পরকীয়া প্রেমের অভিযোগ এসেছে। তিনি নাকি এক বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। একজনের একটি লেখা পড়লাম এর উপর। লেখক সেই বিখ্যাত নারীর কাছে কৈফিয়ত চেয়েছেন, কেন তিনি এরকম একটা অনৈতিক সম্পর্কে জড়ালেন।

সেই লেখা এবং কিছু কমেন্ট পড়ে বুঝতে পারলাম যে, সেই নারী যে পুরুষের সাথে জড়িয়েছেন, তার স্ত্রী সব জায়গায় নিজের স্বামীর কৃতকর্মকে আড়াল করে সেই নারীটিকেই মূলত দায়ী করছেন তার সংসার ভাঙ্গার কারন হিসেবে।

যবে থেকে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির জন্ম, বোধকরি তখন থেকেই বিবাহ বহির্ভূত প্রেম যাকে আমরা পরকীয়া বলি তারও উৎপত্তি। মানুষের মনস্তত্ত্ব বড় জটিল। বিজ্ঞান বলে মানুষ মূলত বহুগামী। সমাজ, ধর্ম, নৈতিকতা এসবের দোহাই দিয়ে আমরা একগামী থাকার চেষ্টা করি। অবশ্য সমাজ, নৈতিকতা কিংবা ধর্মের বিধান নারী এবং পুরুষের জন্য আলাদা, যে আলোচনা এখানে উহ্য রাখছি।

একটি নারীর স্বামী যখন পরকীয়া সম্পর্কে জড়ায় তখন সেই নারীটির জন্য এর চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা আর কিছু হতে পারেনা। নারীটি নিজকে চরম অপমানিত মনে করে এবং সেই সাথে ধ্বংস হয় তার বিশ্বাস, সংসার, স্বপ্ন সব। সন্তানদের ভবিষ্যত হয় অনিশ্চিত। আমাদের দেশে বহু নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বামীর উপর নির্ভরশীল, সেহেতু স্বামীর পরকীয়াতে স্ত্রীদের জীবনে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দু’দিক থেকেই নেমে আসে বিশাল বিপর্যয়। সুতরাং এরকম একটা ঘটনা  স্ত্রীটির মনোজগতে নিদারুণ আলোড়ন তুলবে এবং সেই সাথে সে  তীব্র মনোকষ্টে  আক্রান্ত হবে তা বলাই বাহুল্য।

এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগ নারী যা করে তা হল, যে নারীর সাথে স্বামীর প্রেম, তাকে তীব্র ঘৃণা করতে শুরু করে। মনে করে তার জীবনের সকল কষ্টের মূল সেই নারী এবং তাকে সরাতে পারলেই বুঝি তার জীবনে আগের মত স্বস্তি নেমে আসবে। এই কারণে বহু স্ত্রী তার স্বামীর প্রেমিকাকে থ্রেট দেয়, গালিগালাজ করে, চুলোচুলি করে এবং সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে।

স্বামীর উপরও তাদের অনেক রাগ অভিমান হয়, ঝগড়াঝাটি করে, তবে তারা স্বামীর চরিত্র হনন ততটা করেন না যতটা করেন স্বামীর প্রেমিকার। অনেকে আবার স্বামীটিকেই আড়াল করতে চায়, যেন ওই ডাইনী তার ভোলাভালা স্বামীটিকে ভুলিয়ে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। এ সব কিছুই স্ত্রীটি করে এই ভয়ঙ্কর ক্ষতি এবং কষ্টের সাথে ডিল করতে গিয়ে। এসব কাজকর্ম তাকে খানিকটা মানসিক শান্তি বা তৃপ্তি দেয়। প্রতিশোধ নিতে পারার আনন্দ দেয়।

একটি বিবাহিত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায় কিন্তু প্রধানত স্বামী এবং স্ত্রীর। স্ত্রীদের বলছি, আপনার সংসার ও পুত্র-কন্যার জন্য আপনার ও আপনার স্বামীর যতটা মায়া আর দায়দায়িত্ব থাকবে ততটা কিন্তু অন্য কারো থাকার কথা নয়। একজন স্বামী যখন নিজের স্ত্রী এবং সন্তানদের ফেলে অন্য এক নারীর পেছনে ছোটে, সেক্ষত্রে যে নারীর পেছনে স্বামীটি ছুটলো, সে নারী কেন সকল দোষের একমাত্র ভাগিদার হবে? আর যদি সেই নারী কারো কাছে কমিটেড না হন, তাহলে কারো সংসার টিকিয়ে রাখার দায়ভারও তার নেই। তাহলে সেই নারী কেন সকল আক্রোশ এবং সামাজিক হিউমিলিয়েশনের টার্গেট হবে?

এসব ক্ষেত্রে স্বামী, যে কিনা মূল নায়ক তাকেই কি প্রধানত দায়ী করা উচিত নয়? তবে কেন স্ত্রীরা স্বামীকে আড়াল করবে?  আপনার স্বামী আপনাকে এবং সন্তানদের ভুলে অন্য একজনের কাছে চলে গেছে বা চলে যেতে চাচ্ছে সে ক্ষেত্রে দোষ যদি দিতে হয় স্বামীটিকেই দিন।

আজকে আপনি ভয় দেখিয়ে, ঝগড়া করে স্বামীর জীবন থেকে বর্তমান প্রেমিকাকে দূর করলেন ঠিক আছে, কিন্তু কালকে যে সে আর একটি নতুন প্রেমিকা জোগাড় করবে না, তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে?

আদর্শিক দিক থেকে কোন মেয়েরই বিবাহিত কারো সাথে প্রেম করা ঠিক না বলে মনে করি। কোন মেয়েরই উচিত নয় জেনেশুনে কোন জটিল সম্পর্কে জড়ানো বা অন্য একটি সংসার ভাঙ্গার ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করা।

জোর করে কোন সস্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায়না বা টেকানো স্বাস্থ্যকরও নয়। এসব ক্ষেত্রে স্ত্রীর উচিত হবে স্বামীর সাথে কথা বলা। তার যাবতীয় রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, কষ্ট স্বামীর কাছে প্রকাশ করা। তার কাছে কৈফিয়ত চাওয়া। কারণ স্বামীটিই এখানে প্রধান আসামী।

এ ধরনের সম্পর্ক থেকে স্ত্রীটি মাথা উঁচু করে বের হয়ে আসতে পারে অথবা সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে সন্তান, সামাজিকতা এসব কারণে। একজন স্ত্রী কতটুকু সমঝোতা করবেন সেটা তার বিষয়। সে যদি তার স্বামীকে আর একটিবার সুযোগ দিতে চায় সেটাও তারই সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে লেকচার দেবার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। কিন্তু মনে রাখবেন সংসার টিকিয়ে রাখলে ভবিষ্যতে আবারো এরকম ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়। বারবার স্বামীর প্রেমিকাদের গালিগালাজ বা দোষারোপ করে খানিক মানসিক প্রশান্তি হয়তো পাওয়া যেতে পারে কিন্তু আসল সমস্যার সমাধান হবে না।

এই জন্য স্বামী অন্য সম্পর্কে জড়ালে তার সাথে কথা বলুন, সময় নিন, ঠান্ডা মাথায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিন। তৃতীয় পক্ষকে ছোট করতে চেয়ে নিজে ছোট হবেন না। অন্যকে অপদস্ত করতে গিয়ে নিজেকে অপদস্ত না করে ডিগনিটি নিয়ে বাঁচুন ।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]