“এ খাঁচা ভাঙ্গবো আমি কেমন করে!”
মাসকাওয়াথ আহসান।। করোনাকালে স্বামী-স্ত্রী লকডাউনে একসঙ্গে ঘরে থাকায়; করোনা চাবি হারিয়ে ফেলায়; আশা করা গিয়েছিলো; সিনেমার ঋষি কাপুর আর ডিম্পল কাপাডিয়ার মতো “ছুঁয়ো না ছুঁয়োনা আমাকে” সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং-এর গানটি এক রোমান্টিক দ্যোতনা নিয়ে হাজির হবে।
কিন্তু সিনেমা যে “আশার ছলনে ভোলায়” তা যে কেবলি ভ্রান্তি বিলাস। গোটা বিশ্বের নানাদেশে স্বামী-স্ত্রীর ম্যারাথন ঝগড়ার সুযোগে; নারী ও পুরুষ নির্যাতনের কান্না ভেসে আসে প্রতিবেশীর কানে।
আদম আর হাওয়া স্বর্গের বাগানে করোনাকালের এমন ঐকান্তিক যুগল জীবনের সুযোগ পেয়েছিলো সে কবে। কিন্তু ভালো থাকতে যে মানুষের ভালো লাগেনা সৃষ্টির আদি থেকে। আদম আর হাওয়ার চব্বিশ ঘন্টা ঝগড়া আর জলপাই গাছের ডাল ভেঙ্গে একে অপরকে বাইড়ানি দেয়ার কোলাহলে; স্বর্গ হয়ে ওঠে যেন আগামির বচসা-কেন্দ্রিক কলতলার প্রতিরূপ।
স্বর্গের পবিত্র প্রতিনিধিদের ধ্যান ও প্রার্থনায় ব্যাঘাত ঘটে; আদম ও ইভের নিত্য-দাম্পত্য কোলাহলে।
এক বৃদ্ধা পবিত্র প্রতিনিধি বলেন, এরা যে স্বর্গকে নরক বানিয়ে ফেলবে; ও’দুটিকে নরকে ছুঁড়ে ফেলো।
অন্য পবিত্র প্রতিনিধিরা বলেন, স্বর্গে বসবাসের মতো শান্ত-সৌম্য-স্থিতধী নয় ওরা। নরকেই যাক; বুঝুক কতধানে কত চাল।
পবিত্র প্রতিনিধিরা আদম আর ইভকে স্বর্গের দরজার বাইরে বের করে দিলে তারা পৃথিবী নামের নরকে হাজির হয়।
চারিদিকে সাপ হিস হিস করে; বুনো শৃগাল এসে ভয় দেখায়। গাছের ওপর প্রথম হাওয়া- ঘর তুলে সংসার শুরু করে আদম ও ইভ। কিন্তু সেই সংসার নামের অচলায়তনে সুযোগ পেলেই ঝগড়া হয়। তেতো হতে থাকে জীবন।
নরকের সাপও এসে গাছের নীচ থেকে জোড় ফণা তুলে অনুরোধ করে, তোমাদের ঝগড়ায় আমরা একটু ঘুমাতে পারি না বাপু।
গাছের ডালের দুই ক্রোঞ্চ-ক্রিঞ্চি-কামমোহিতম ভীষণই বিরক্ত হয় নর-নারীর এই ভালোবাসাহীন কোলাহলে।
সেজ খালা প্রকৃতির এক বানর এসে ইভের কানে কানে বলে, একটু নাতি নাতনির মুখ দেখাও।
সেজ খালু প্রকৃতির বানর খালু আদমকে বোঝায়, অবসর জীবন কাটাচ্ছি, একটা খেলনা এনে দাও।
ইভ সন্তান সম্ভবা হলে তার মেজাজ আরো তিরিক্ষি হয়। সেজ খালা প্রকৃতির খালারা ফিসফাস করে, সন্তান সম্ভবা হয়ে যেন ইভ আরো স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। আমরা কী সন্তান সম্ভবা হইনি কোনকালে! ঢং দেখলে বাঁচিনা।
সেজখালু প্রকৃতির এক বানর গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করে, আদম কেন ইভের এমন চাকর হয়ে উঠলো!
সেজখালারা কপাল চাপড়ে বলে, আদম কেন চাকর?
সেই থেকে আদম ইভের দাস হয়ে পড়ে। স্ত্রৈণতন্ত্রের খাঁচায় বন্দী হয় আদমের জীবন।
ইভ গিয়ে সেজখালা বানরকে বোঝায়, আপনারা পুরুষবানরতন্ত্রের বলি। আর কতো ঘুমিয়ে থাকবেন; উঠুন, বুড়ো বানর খালুকে আপনার পা টিপে দিতে বলুন।
আদমের কাজ তখন খাদ্য ও ফলমূল সংগ্রহ, হাওয়া-ঘর ধুয়ে মুছে রাখা আর বাচ্চাকে বিকেল বেলা খেলতে নিয়ে যাওয়া।
হাওয়া তখন নরকের সেলিব্রেটি হয়ে নারী বানরদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে বেড়ায়। হাওয়া যেন হাওয়া আপ্পি।
আদমের জীবন তখন, “কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে বাঁশী সংগীত হারা; লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে।”
হাওয়া স্বৈরতন্ত্রের খাঁচায় বন্দী আদমের তালপাতার বাঁশী হাওয়ায় ছুঁড়ে ফেলে। গান গাইতে চাইলে ধমক দেয়, মিনসে বাচ্চা ঘুমাচ্ছে; সেদিকে খেয়াল নেই।
বেদনা লীন আদম একদিন মন খারাপ করে বসে ছিলো এক নরক কাননে। চকিতে এক লাস্যময়ী নারী “এসো এসো সুরে করুণ মিনতি মাখা।”
আদম স্তম্ভিত হয়; নারী কণ্ঠ এমন মায়াভরা হয়! চোখে তার এতো ভালোবাসা থাকে নারীর হাওয়া আপ্পিকে দেখে তা বুঝিনি।
আদমের কণ্ঠে সুর আসে, “আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন। দিল ওহি মেরি ফাস গ্যায়ি।”
আদম “হাওয়া ঘরে” ফিরলে তার কাছে চন্দন কাঠের সুবাস ভেসে আসে। তার সন্দেহ হয়। চেঁচিয়ে নরক মাথায় তোলে।
–বলো আজ বিকেলে কোথায় গিয়েছিলে; কার কাছে গিয়েছিলে? “কী কথা তাহার সনে?”
–তোমার মাথা খারাপ হয়েছে হাওয়া? পৃথিবী নামের নরকে আমরাই প্রথম নর-নারী; তৃতীয়টি আমাদের শিশু। এখানে আর কে আসবে আমার সঙ্গে কথা বলতে; বাচ্চাকে পটি করানো ছাড়া আর কী আছে আমার জীবনে!
এ কথা শুনেই শিশুটি খিল খিল করে হেসে আদমের মাথায় পটি করে দেয়।
আদম বলে, কোন অসুবিধা নেই বাবা; তোর মা ভালোবাসার পুলিশ হয়ে ডান্ডা নিয়ে তেড়ে নিয়ে এলেই; আমার মাথায় পটি করিস। বেঁচে যাবো মারের হাত থেকে।
এরপর কিছুকাল অবসর পেলেই আদম ছুটে যায় অনাম্নী আলেয়ার কাছে; ম্যাজিক ফ্যান্টামের মতো সে আদমকে নিয়ে যায় ময়ূর আর হরিণের বাগানে।
সেজ খালা প্রকৃতির বিশ্রামে আহত বানরেরা নরকের ফুচকি দিমু সমাজের গোয়েন্দাগিরি ও পরচর্চার বিনোদনের আয়োজক। তাদেরই একজন আদমকে আবিষ্কার করে অচেনা লাস্যময়ীর সঙ্গে।
তারা হাওয়ার কাছে গিয়ে “আদমের গোমর ফাঁস” কইরা দেয়। বানর সমাজে ছ্যা ছ্যা পড়ে যায়।
আদম ফিরলে হাওয়া ঝাড়ু নিয়ে তেড়ে আসে; অমনি শিশুটি তার বাবার মাথায় পটি করে দেয়।
হাওয়া বলে, এখন থেকে তুই লকডাউনে থাকবি। এইসব ইটিশ-পিটিশ বাদ দে।
বানর সমাজের মাঙকি শেমিং-নরকের কলতলায় একাডেমিক ক্যারেকটার অ্যাসাসিনেশান টকশো; প্রাক-বৃদ্ধা বানরীরা সেখানে বসে লম্পট আদমের ফাঁসি দাবি করে। সেই টকশোতে এক বানরী বলে, মি টু; আমিও আদমের সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার। সে আমাকে গান শুনিয়ে আমার সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও কথা রাখেনি। আপনারা আদমকে শাস্তি দিন।
বানরপিটুনিতে আদমের মরার জো হয়। হাওয়া আপ্পি নিজের নেতা ক্যারিয়ারের কথা ভেবে আদমকে অভিশংসনের হাত থেকে বাঁচায়।
ট্র্যাডিশনাল বানর ফুপ্পিরা বোঝায় হাওয়াকে, যা একটু পুষ্পের অলংকরা পরে আয়; আদমকে ভালবাসার লকডাউনে বন্দী করে রাখ।
অনেকদিন পর “অনাম্নী জাদু-নেশা”-র বাইরে প্রেমের সঙ্গে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং-এ আবার “আদম কেন চাকর” হয়ে ওঠে হাওয়া ঘরে।
পূর্ণচন্দ্রের রাতে চন্দনের সুবাসে পুষ্প-সালংকারা হাওয়া আদমের কাছে এলে; মাঝে কাছিমের মতো চিত হয়ে শুয়ে থাকা শিশুটি বাবার বিপদ ভেবে তার মাথায় পটি করে দেয়।