সন্তানকে সেরা বানাতে গিয়ে মারাত্মক ভুল করছেন না তো?
তনুশ্রী দেবনাথ।। এবার এস এস সির রেজাল্টের পর ১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। প্রতিবার রেজাল্টের পর শোনা যায় এরকম আত্মহত্যার খবর। এর পেছনে দায়ী আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং সর্বোপরি পিতা মাতার অতি প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব। একদম ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের আমরা প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেই। সেরা হতে হবে- এই বলে তাদের জীবনকে ছোট্ট গণ্ডিতে বেঁধে ফেলি, সেখানে থাকে শুধু স্কুল, কোচিং আর টিউশন।
আমি একজন স্কুল শিক্ষক, আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা এখানে বলব। ক্লাসে যখন জিজ্ঞেস করি ‘‘পড়াশোনার বাইরে অন্য সৃজনশীল কিছু কেউ শিখছ?’’ তখন বড়জোর দুইজন হাত তোলে, কখনো একজনও নয়। ‘‘গল্পের বই পড়?’’ কারো উত্তর হয়, ‘‘আমাদের বাসায় কোনো গল্পের বই নেই।’’ কেউ বলে ‘‘আম্মু সব গল্পের বই তালা দিয়ে রেখেছে।’’ গান, নাচ, আবৃত্তি শেখার সময় নেই। সারাদিন শুধু পড়াশোনা আর বাকি সময় মোবাইলে গেমস। বাচ্চারা মানবিকতা চর্চার জায়গাটুকুও পাচ্ছে না। অন্যদিকে এক নম্বর কম পাওয়ার অপরাধে বাচ্চাদের করা হয় চরম অপমান। এমনও দেখেছি কম নম্বর পেয়েছে বলে স্কুল গেটেই মারছেন মা, মারতে মারতে তুলছেন গাড়িতে। ক্লাস পরীক্ষায় যদি এক নম্বর কমে যায়, সেই ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে পরীক্ষা দিতে দেখেছি। দেখেছি নম্বর কম পেয়েছে বলে বাবা মেরে মেরে রক্তাক্ত করেছে। এই শিক্ষার্থীরা যখন ফেল করবে তাদের মনের অবস্থাটা কী হবে?
আমি তখন কলেজে পড়তাম, আমাদের বাড়ির পাশে একটা পরিবার ভাড়া থাকত। নিজেদের বাচ্চাকে যে এইভাবে টর্চার করা যায়, কেউ বিশ্বাস করতাম না নিজে চোখে না দেখলে। আমরা কিছু বলতে গেলে আন্টি আমাদের অপমান করত। শলার ঝাড়ু দিয়ে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফেলত। কতদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুই ভাই দরজায় বসে কেঁদেছে- ‘‘আর করব না আম্মু।’’ তাদের মা বাবা যেকোনো অপরাধে তাদের বের করে দিয়েছে। আমরা গিয়ে দরজা ধাক্কা দিয়েও উত্তর পাইনি। জানি না এই বাচ্চাগুলো পরীক্ষায় ফেল করলে বাবা মায়েরা কী করবেন! এরা এখন কোথায় আছে কি করছে কিছুই জানি না।
ওইদিন আমার এক বন্ধু জানালো, ওদের পাশের ফ্ল্যাটে এক বাচ্চাকে বাবা মা কত ধরনের অত্যাচার করে। প্রায়ই বারান্দায় আটকে রাখে, আর প্রচুর মারে। আমার বন্ধুটি তাদের সাথে কথা বলেও কোন কাজ হয়নি। এখন সে বলছে এরপর ৯৯৯ এ কল দেবে।
এর বিপরীতে কিছু অভিভাবক আক্ষেপ করেন, সন্তানরা খুবই অবাধ্য। বিশেষ করে ১৩ থেকে ১৭ বছরের শিক্ষার্থীরা। চাহিদা মোতাবেক জিনিস না পেয়ে বাসায় ভাংচুর করে, আত্মহত্যার হুমকি দেয়। ক্ষেত্রবিশেষে মা, বাবার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করে না। ১৬ বছর বয়সে মোটর সাইকেল কিনে দেয়নি বলে লেকে ঝাঁপ দিয়েছিল একজন এস এস সি পরীক্ষার্থী, এটা দুই বছর আগের কথা। সাথে সাথে অবশ্য লোকজন তাকে তুলে ফেলে, সে এখন সুস্থ। তবে বাচ্চারা এখন জেনে গেছে আত্মহত্যার হুমকি একটি বিশেষ ব্যাপার, এতে করে বাবা মাকে জব্দ করা যায়।
হয়তো এরকম অতি প্রতিক্রিয়াশীল বাবা মা খুব বেশি নেই, তবু কমও নেই। এখানো আমাদের সমাজে ধারণা প্রচলিত, ‘‘মারের উপর ওষুধ নেই।’’ বাবা, মা, শিক্ষক এরা অবশ্যই শাসন করবেন, কিন্তু তা যেনো কখনোই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে না যায়। সরকার স্কুলে সকল ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করেছেন। সময় এসেছে পারিবারিক সকল ধরনের নির্যাতন বন্ধ করার। সন্তানকে সেরা বানাবার প্রতিযোগিতায় নেমে তার জীবন ধ্বংস করবার মত মারাত্মক ভুল আর করবেন না।
তনুশ্রী দেবনাথ: শিক্ষক, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল