September 20, 2024
কলামফিচার ২

নারীর পাশে নারী নেই কেন?

আঞ্জুমান রোজী।। নারীর পাশে নারী কতটুকু থাকছে? নারীর আশ্রয় নারী হতে পারছে কি? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রশ্নগুলো রাখলাম। কারণ, উন্নত বিশ্বে নারীর চিত্র অন্যরকম। আমার কথাই বলতে পারি। আমি কানাডায় বসবাস করি। একাকী জীবনযাপন করতে গিয়ে বিভিন্ন কাজেকর্মে সবচেয়ে বেশি সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছি অন্য নারীর থেকে। ব্যাংক, বাচ্চাদের স্কুল, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, কোর্ট, কার ডিলার শপ- যেখানেই গিয়েছি নারীদের সহযোগিতা পেয়েছি। প্রথম অবস্থায় অনেককিছু বুঝতাম না বলে ব্যাংকের নারী কর্মীরা হাতে ধরে আমাকে শিখিয়েছে। চাইল্ড ট্যাক্স বেনিফিটের জন্য সব রকম ইনফরমেশন রেভিনিউ কানাডায় কল করে আমাকে সামনে বসিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নিয়ে সব কিছু সেট করে দিয়েছে, যে কাজটি আমারই করার কথা। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে শুধু তাকিয়ে থাকতাম। কোথায় কোথায় সাইন করতে হবে তা করে দেয়ার পর বলত সবকিছু সেট, এখন তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। তারপর ফিরে আসার সময় বলত, কোন প্রয়োজন হলে যেন আমি তাকে কল করি। এরপর গিয়ে তাকে আর পাইনি। অন্য ব্যাংকে বদলি হয়ে চলে গেছে। যখনই ব্যাংকে যেতাম সেই নারী অফিসারের কথা জিজ্ঞেস করতাম। আর পাইনি তাকে কিন্তু তার জন্য মনে মনে এখনো প্রার্থনা করে যাই। এমন নাহলে আমার জীবন এতো সহজসরল হয় কেমন করে? এমনকি কাজের জায়গায় মাথা উঁচু করে মর্যাদার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে যেভাবে বড় হচ্ছিলাম, যেভাবে আমাকে সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছিল সেই সমাজ সংসার, তা থেকে মনের ভেতর এক ধরণের আড়ষ্টতা জন্ম নিয়েছিল বটে। তবে প্রতিমুহূর্তে মুক্তির পথ খুঁজতাম। কারণ, নিজের উপর আত্মবিশ্বাসটা ছিল প্রবল। আর আমি এটাও বিশেষভাবে বলতে পারি, বাংলাদেশে থাকলে আমার জীবন এতোটা মসৃণ ও সহজ হতো না।

কাউন্সিলিং এর ব্যাপারে যে বিষয়টা কানাডাতে দেখি, কোনো নারী সমস্যায় পড়লে কাউন্সিলরের এর কাছে যায়। সেখানে ভিক্টিম নারীর সব রকম কথা শোনার জন্য যে ধরণের আন্তরিকতা এবং স্নেহের আচরণ দেখায় তা কল্পনাতীত। ভিক্টিম নারীটি তখন নির্ভয়ে মনের সকল কষ্ট ঢেলে দেয়। কাউন্সিলর সব রকম গোপনীয়তা রক্ষা  ক’রে ভিক্টিম নারীকে সঙ্গ দেয়। নারীই যে নারীর আশ্রয়স্থল তা কানাডায় না এলে বুঝতে পারতাম না। ন্যায় অন্যায়ের পাল্লা নারী পুরষ সবার জন্যই সমান। তবে নারী যেহেতু সবসময় অবহেলা এবং প্রতারণার শিকার হয়ে আসছে, সেজন্যে নারীর দিকেই মনোযোগটা থাকে বেশি। সেইসাথে ভিক্টিম নারীর সব রকম  নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে থাকে। নারীটিও ধীরে ধীরে নতুন করে বাঁচার উদ্যোগ পায়। এমন দৃশ্য দেখার পর বাংলাদেশের চিত্র ভাবি। সেখানে পুরুষ তো নারীর পাশে থাকেই না, এমনকি নারীও অনেকসময় নারীর পাশে থাকে না; নারীর কথা মন দিয়ে শোনা তো দূরে থাক।

সাধারণ এবং খুবই ন্যাক্কারজনক যে বিষয়টি নারীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ঘটে তা হলো, পুরুষ দ্বারা প্রতারিত নারীর পাশে অনেক সময় কোন নারী তো থাকেই না; এমনকি এক নারী আরেক নারীর কাছে মন খুলে কথা বললেই তার কিছুদিন পর হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে সেই নারীটিকে হেয় করে ছাড়ে। এমন আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। নারীর গোপনীয়তা নারী যদি রক্ষা করতে না পারে তাহলে কোন নারীই একা দাঁড়াতে পারবে না। তাছাড়া পুরুষ দ্বারা লাঞ্ছিত নারীর পাশে নারী না থাকলে সেই নারীর  আশ্রয় আসলে কোথাও থাকে না। এমন দৃশ্যের মুখোমুখি অনেক নারী হয় বলে পরবর্তীতে নারী তার নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। অথচ নারীর আশ্রয় নারীর কাছে না হলে সমষ্টিকভাবে নারীর কোন সমস্যার সমাধান কোনো আইনও দিতে পারবে না। জীবন চলার পথে এবং জীবনের পরতে পরতে নারীকে নারীর পাশেই থাকতে হবে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যব্যস্থায় নারীর পাশে নারীকে পাওয়া খুবই কঠিন একটি বিষয়। কিন্তু যারা নারী নিয়ে কাজ করছেন বা নারী বিষয়ক লেখালেখি করছেন তাদের কাছ থেকে তো বিমাতাসুলভ আচরণ কোনো নারী আশা করতে পারে না। অথচ বাস্তবে এমন রূঢ় অনেক কিছুই দেখতে হচ্ছে। যার কারণে দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হওয়া সত্ত্বেও নারী তার পূর্ণ শ্রম ও মেধা দিয়েও আজো তার জায়গা করে নিতে পারছে না। কারণ একটাই এবং এটাই মূল কারণ যে, নারীর পাশে নারী নেই। বাংলাদেশে নারী নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো কতটা স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে কাজ করছে সেটাও প্রশ্ন করার বিষয়। তবে বৃহদাকারে কাজ করার আগে ব্যাক্তি পর্যায়ে নারীর সঙ্গে নারীর সম্পর্কটা স্বাভাবিক, আন্তরিক, সহজসরল এবং বিশ্বাসযোগ্য হওয়া উচিৎ ।

আরেকটা কথা না বললেই নয়, নারীবাদ নিয়ে যে বিতর্ক, সেই বিতর্কে অনেক নারীই সামিল হচ্ছেন এবং নিত্য-নতুন ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন। নারীর যে সমস্যা তার কিছুটা নারীর নিজেরও। কারণ সে পুরুষের উপর নির্ভর করে চলতে ভালবাসে। তাছাড়া নারীর সমস্যার সমাধান আইনের ধারা বা সামাজিক দণ্ডবিধির আওতায় এনে সুরাহা করা যেতে পারে। তাই বলে কোন নারীর ব্যক্তিজীবন টেনে এনে নারীবাদকে হেয় করার অধিকার কোনো নারীই রাখে না। এমন হীনমন্যতা দেখায় শুধু সেসব নারী যারা অন্য নারীর শত্রু হয়ে থাকে এবং তারাই ভেতরে ভেতরে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পোষণ করে। এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নারীবাদকে কটাক্ষ না করে নারী যেন নিজেই নিজের দিকে ফিরে তাকায় সেই কামনা করি। লোভ, ঘৃণা, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা ও স্পর্শকাতরতার উর্ধ্বে উঠে নারী যেনো স্বকীয় ব্যক্তিত্বে জেগে ওঠে এবং সেইসাথে নারীর শত্রু নারী না হয়ে বরং একে অপরের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়- এমনটাই প্রত্যাশা করি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]