পিরিয়ডের ‘লজ্জা শরম’, ইসলামের নির্দেশ ও আমাদের দ্বিচারিতা
স্নিগ্ধা রেজওয়ানা।। কোন বহুজাতিক কোম্পানির কোন পণ্যের প্রমোশন নিয়ে লেখার কোন ইচ্ছা বা বাসনা আমার ছিলনা। কিন্তু বলতে পারেন নিতান্ত বাধ্য হয়ে লিখতে বসেছি।
গত সপ্তাহে সেনোরা প্যাড নিয়ে একটি টিভিসি প্রচারিত হয়েছে, যেখানে দেখানো হয়েছে, একজন ভাই তার বোনের জন্য প্যাড কিনে দিচ্ছে। আর তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এদের মাঝে একটি বড় দল নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, বলতে পারেন তাদের কারনেই লেখাটি না লিখে আমি থাকতে পারলাম না। যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে এই টিভিসির বিরুদ্ধচারণ করছেন এবং যে সকল মেয়েরা ‘‘বেহায়াপনা’’, ‘‘লজ্জা শরমের মাথা খাওয়া” ইত্যাদি নানা বক্তব্য দিয়ে এই টিভিসির মূল বার্তা- মাসিক বা পিরিয়ডের স্বাভাবিকত্ব অস্বীকার করার প্রয়াস চালাচ্ছেন তাদের জন্যই আমার এই লেখা।
যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে নানাবিধ বক্তব্য প্রদান করছেন যে ভাই কোনভাবেই বোনকে প্যাড কিনে দিতে পারে না, তাদের কাছে আমার একটি প্রশ্ন আছে, কোরআনের কোথায় বলা আছে মাসিক নিয়ে মেয়েরা প্রকাশ্যে কথা বলতে পারবেন না? বা ভাইদের এ বিষয়ে আলাপ করা নিষেধ? পবিত্র কোরআনেই যদি পিরিয়ড নিয়ে আয়াত থাকে, এবং কোরআন যদি নারী-পুরুষ উভয়ের পাঠের অধিকার থাকে, কোরআনের আয়াত বিষয়ে যদি আমরা প্রকাশ্যে সকলের মাথে আলাপ করতে পারি, তবে সেক্ষেত্রে কী কারনে ভাই তার বোনকে প্যাড কিনে নিতে পারবে না? নাকি ভাই, বাবা বা অপর পুরুষেরা কোরআন পাঠ করার সময় নিম্নোক্ত অংশ পাঠ করেন না, বা পিতা বা ভাইয়েরা কন্যা বা মেয়েদের সামনের কোরআনের এই অংশ পাঠ করা থেকে বিরত থাকেন!
সূরা আল বাকারা (البقرة), আয়াত: ২২২
وَيَسْـَٔلُونَكَ عَنِ ٱلْمَحِيضِ قُلْ هُوَ أَذًى فَٱعْتَزِلُوا۟ ٱلنِّسَآءَ فِى ٱلْمَحِيضِ وَلَا تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّىٰ يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ ٱللَّهُ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلتَّوَّٰبِينَ وَيُحِبُّ ٱلْمُتَطَهِّرِينَ
উচ্চারণঃ ওয়া ইয়াছআলূনাকা ‘আনিল মাহীদি ক্বুল হুওয়া আযান ফা‘তাঝিলুন্নিছাআ ফিল মাহীদি ওয়ালা-তাকরাবূহুন্না হাত্তা-ইয়াতহুরনা ফাইযা-তাতাহহারনা ফা’তূহুন্না মিন হাইছুআমারাকুমুল্লা-হু ইন্নাল্লাহা ইউহিব্বুত্তাওওয়া-বীনা ওয়াইউহিব্বুল মুতাতাহহিরীন।
অর্থ: আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে হায়েয (ঋতু) সম্পর্কে। বলে দাও, এটা অশুচি/কষ্ট। কাজেই তোমরা হায়েয অবস্থায় স্ত্রীগমন থেকে বিরত থাক। তখন পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হবে না, যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়ে যায়। যখন উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে, তখন গমন কর তাদের কাছে, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে হুকুম দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদেরকে পছন্দ করেন।
উপরোক্ত এই আয়াতটি নারী পুরুষের স্বাভাবিক যৌনসম্পর্ক নিয়ে আমাদেরকে শিক্ষা প্রদান করে, যৌন শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে। তাহলে একটি মেয়ের প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটা পিরিয়ড ও স্বাভাবিক প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় আলাপটুকু কেন সে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে করতে পারবে না? এটি নিষিদ্ধ, খারাপ- এই রকম চিন্তা চেতনা কেন পোষণ করা হয়?
তাছাড়া, কোরআনের পরতে পরতে পরিস্কার পরিছন্নতা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা ঈমানের অঙ্গ বলা হয়। স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে মধ্যদিয়ে মেয়েরা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে নিজেদেরকে পরিষ্কার রাখে যেটিকে আমরা হাইজিনের ধারণার সাথে যুক্ত করে থাকি। কাজেই এই স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রতিটি মেয়ের জন্য আবশ্যকীয় পণ্য যা তাকে নিরাপদ সুস্থ জীবন দেয়। একটি মেয়েকে সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে ভাই তার বোনকে সহযোগিতা করতে পারবে না, বাবা তার কন্যাকে সহযোগিতা করতে পারবে না, এরকম কোন নির্দেশ আদৌ ইসলাম দেয় কি? অযথা মিথ্যাচার করে, নিজেদের পৌরুষের মিথ্যা বাহাদুরি আর সুরসুরি মার্কা যৌনতা ঢাকতে দয়া করে ইসলামকে সবকিছুর মাঝে টেনে আনবেন না। এতে শুধু ধর্মের নামে অপপ্রচার হয়।
এবার আসি কিছু শিক্ষিত নারীপুরুষ যারা ভাই-বোনের পিরিয়ড নিয়ে আলোচনা বিষয়টিকে লজ্জা-শরমহীনতা বা বেহায়াপনা ইত্যাদি হিসেবে আখ্যায়িত করছেন, তাদের প্রসঙ্গে। সত্যি বলতে কি এই শ্রেণির প্রতি আমার কেবলই খারাপ লাগা কাজ করে। মূলত এই শ্রেণির মানুষগুলোই পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শের ধারক এবং বাহক। অন্যদেরকে তাও ক্ষমা করে দেওয়া যায়, এই ভেবে যে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করাটাই তাদের একমাত্র কাজ, কিন্তু এই শ্রেণির মানুষজনের এই যে মানসিক দৈন্য, ঠিক এই কারণেই আজকে আমরা মেয়েরা এতটা পিছিয়ে আছি। যদি পিরিয়ডের মত একটি অতি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে আপনি কথা বলতে না পারেন তবে সেই সমাজে কীভাবে একটি মেয়ে প্রতিনিয়ত তার সাথে হয়ে যাওয়া যৌন হয়রানি বা তার সাথে ঘটে যাওয়ার যৌন সহিংসতা বিষয়ে প্রকাশ্যে আলাপ করতে পারবে? ভেবে দেখুন তো, ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়ে যদি আমরা এখনো স্বাভাবিক প্রজনন স্বাস্থ্য, যৌন স্বাস্থ্য অথবা পিরিয়ডের মত অতি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে আলাপ করতে না পারি, তবে সেই সমাজের যৌন হতাশা, যৌনতা বিষয়ক আলাপ যা কিনা চিকিৎসাশাস্ত্রে এবং পলিসি লেভেলে জরুরি বলে বিশেষজ্ঞ ও একাডেমিকরা মনে করেন, তা কী করে সম্ভব? তাছাড়া আজ যে মেয়ে প্রকাশ্যে অতি স্বাভাবিক পিরিয়ড নিয়ে, স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে সবার সাথে কথা বলতে পারছে না, কাল সেই নারী কীভাবে তার বিবাহিত জীবনে যৌন সম্পর্কের অসন্তুষ্টির, যৌন নির্যাতনের কথা পরিবারের আর দশজন সদস্যের সাথে বলতে পারবে, জানাতে পারবে? অথচ প্রজননস্বাস্থ্য জ্ঞান অর্জন করা একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার জন্য আরো বিশেষভাবে জরুরি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয়, প্রজনন অঙ্গ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সুস্থ ও সঠিক ধারণা থাকলে সেটা একটি কিশোর কিশোরীর মানসিক গঠনে সাহায্য করে। তবে বাংলাদেশের সমাজে যুগ যুগ ধরে চলা সামাজিক জড়তার কারণেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিজ্ঞানসম্মত কোন জ্ঞান ছাড়াই পার করছেন। বাংলাদেশে তিন কোটি ৬০ লাখ কিশোর-কিশোরী রয়েছে, যারা এদেশের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। (সুত্র: ইউনিসেফ)। কেবলমাত্র সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, বিদ্যালয়ে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষার অভাব এবং মা-বাবা, আত্মীয় স্বজন ও শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা না পাওয়ার কারণেই তারা ভুল জানে, ভুল কথা বিশ্বাস করে এমনকি সঠিক তথ্য না জানার কারণেই পরবর্তী জীবনে তাদের নানাবিধ যৌনস্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগতে হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত সমাজে অত্যন্ত কম। অন্যদিকে গ্রামীণ ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মাঝে গবেষণা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, যে প্রজনন স্বাস্থ্য ও যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান তুলনামূলকভাবে তাদের একটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। আবশ্যিকভাবেই এর কৃতিত্ব দেশের বিভিন্ন এনজিও সংস্থাগুলোকে দিতে হবে। সত্যি বলতে কি, ক্ষেত্রবিশেষে আমার কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে গার্মেন্টস কর্মী, গ্রামীণ বা বস্তিতে বসবাসরত নারীকে, প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে যতটা সচেতন করতে পেরেছে তাদের বাস্তবতার নিরিখে, তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনি সে তুলানায় তথ্যগত ও মনজাগতিক পরিসরেও অনেক পিছিয়ে আছে। আর তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণির এই মানাসিক দৈন্য প্রগাঢ়ভাবে সামনে উঠে আসে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা কিছু শিক্ষিত ছেলে মেয়েকে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিষয়ক ভাই-বোনের মধ্যকার আলাপচারিতায় ‘বেহায়াপনা, লজ্জা বা শরম’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতে দেখি।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে মধ্যবিত্ত নারীদের মাঝে গবেষণার কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, এই তথাকথিত লজ্জা-শরমের চাপায় প’ড়ে বহু মেয়ে, মা, বোনেরা দীর্ঘকাল নানা ধরনের রোগে ভুগতে থাকেন, যা তারা কারো সাথে শেয়ার করতে পারে না। ফলশ্রুতিতে ইউরিন ইনফেকশন যা পরবর্তীতে কিডনি রোগে গড়ায়, অনিয়মিত পিরিয়ড, ইউরেটারিয়ান প্রোলাপ্স, সিস্ট, ব্রেস্ট ক্যান্সার, জরায়ুমুখ ক্যান্সার ইত্যাদি নানাবিধ জটিল রোগের দ্বারা তারা আক্রান্ত হন। আমাদের তথাকথিত লজ্জার ডিসকোর্স দিনের পর দিন মা, খালা, ফুপু, দাদী, নানীদের মানসিক ও শারীরিকভাবে অসহায় করছে। যত শক্তি, সাহস, ধৈর্যের সাথে তারা পরিবার সামলান, এই লজ্জা-শরমের ট্যাবুর তাদের সামনে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই দয়া করে এই মানসিক দৈন্য থেকে বেরিয়ে আসুন। নয়তো খোদ আপনার পরিবারের কন্যাসন্তানটিই হয়ত পরবর্তী জীবনে ভুগতে পারে যৌনস্বাস্থ্যগত জটিলতায়, যা হয়তো আপনার তথাকথিত লজ্জা শরমের কষাঘাতে তার প্রানটিও কেড়ে নিতে পারে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]