কর্মক্ষেত্রে অসুর নিপাত যাক্!
সানজিদা সামরিন।। পৌরাণিক উপাখ্যানে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে যেমন যুদ্ধে পরাজিত করেছেন, তেমনি বর্তমানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কর্মক্ষেত্রে মহিষাসুররূপী পুরুষ বস বা কর্মকর্তার সঙ্গে দশভূজারূপী নারী কর্মীরা লড়াই করছেন। ক্ষেত্র বিশেষে পরাজিতও করছেন বৈকি! এই মহিষাসুরের পরিচয় আসলে কী?
মহিষ একটি পশুর নাম তা আমরা জানি। আর অসুর মানে সুরের বিরোধী, যে কিনা দেবদেবী কাউকেই গ্রাহ্য করে না! সে প্রকাণ্ড শক্তি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় যার সবটাই অসৎ পথে খরচ হয়। পুরাণে অসুর কঠিন তপস্যার মাধ্যমে ব্রহ্মার বলে বলীয়ান হয়। মহিষসহ বিভিন্ন রূপ ধারণ ধরে দেবী দুর্গার সাথে যুদ্ধ করেছে সে। তাই কর্মক্ষেত্রেও এই চরিত্রের কিছু পুরুষ কর্মকর্তার অধীনস্থ হয়ে নারীকে অহড়হই কাজ করতে হয়। এই কাজ আবার দুইভাবে করা যায়। প্রথমত, অসুরের হস্ত-পদ তৈলমর্দন করে, সুস্বাদু খাদ্য খাইয়ে বা তোষামোদ করে। দ্বিতীয়ত, সৎপথে থেকে বা আত্মসম্মান বজায় রেখে। দ্বিতীয় কাজটি যেসব নারী করেন তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারেন না। হয়ে যান অসুরের এবং অসুরের হস্ত-পদ মর্দনকারীদের চক্ষুশূল। এই দুই ধরনের নারী যেন একই মায়ের দুটি সন্তান- একটি দেবী ও অন্যটি অসুর।
যেসব পুরুষ কর্মকর্তা আসুরি অবস্থা লাভ করেছেন তাদের মধ্যে পরশ্রীকাতরতা, পরচর্চা, অহঙ্কার, ক্রোধ, কর্কশ ব্যবহার, অবিবেচনা ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়। ক্ষমতার বলে অনেক নারীরাও এর ব্যতিক্রম নন। আসুরিক এবং পাশবিক এই দুটি ভাব-শক্তিতে বলীয়ান মহিষাসুরের প্রতিরূপ তারা। যারা পৌরাণিক যুগ হতে আজ অবধি দুর্গাদের দশদিক থেকে আক্রমণ করে আসছেন। তাই দেবী দুর্গারূপী নারীরাও দশ হাতে যুদ্ধ করে দুর্দমনীয় মহিষাসুরকে পরাজিত করে। এ যুদ্ধ চিরকালের। সু ও কু-এর মধ্যে জনম জনমের লড়াই।
তবে কর্মক্ষেত্রে সকল নারীই দুর্গা নয়, একথা প্রমাণিত। গুতিকতক যারা দৈবী সম্পদলাভ করেছে তাদের মধ্যে ভয়শূন্যতা, নমনীয়তা, সত্যতা, কর্মনিষ্ঠা, সহযোগিতা, তপস্যা, সরলতা, অহিংসা, ক্রোধহীনতা, ত্যাগ, শান্তি, পরদোষ প্রকাশ না করা, অসৎচিন্তা ও অসৎ কর্মে লজ্জা, অচপলতা, তেজ, ধৈর্য, ক্ষমা, পরোপকার, ইত্যাদি গুণাবলী লক্ষণীয়। এগুলো দৈবশক্তি। অধিকাংশ সময় কর্মক্ষেত্রে আসুরিক প্রভাব প্রবল থাকায় গুটিকতকের দৈবীভাবগুলো খুব সহজে প্রকাশিত হতে পারে না।
তবে সত্য এই যে হস্ত-পদ মর্দনকারী নয় বরং দেবী দুর্গার ন্যায় নারীরা প্রকৃতপক্ষে জয়ী। তাদের পদতলেই মহিষাসুরের অবস্থান। যুগে যুগে সকল যুদ্ধের পূর্বে অসুরের ধারণা হয় দেবী দুর্গা সামান্য অবলা নারী, যা কিনা পুরুষের ভোগের বস্তু ব্যতীত আর কিছুই নয়। কিন্তু মহিষাসুর যুগে যুগে আবির্ভূত হয়ে ও পরাজিত হয়ে হয়ত আজও উপলব্ধি করতে পারেনি যে দেবী দুর্গা ভোগের বস্তু নয়, সে সামান্য নয়, কামনা চরিতার্থ করার জন্য নয়।
সকল নারীকেই সোচ্চার হতে হবে কর্মক্ষেত্রে সকল অপমান, অবহেলা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তবেই হয়ত কোনো একদিন কর্মক্ষেত্রে অসুর মানবের পরিবর্তন হয়ে সব দেবমানব হবে। সেখানে নারীর পথচলা হবে সহজ ও সুন্দর ও আনন্দময়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]