November 21, 2024
সাহিত্যগল্প

বিড়াল

সায়মা আরজু।। গ্রীলের ফাঁক গলিয়ে অনায়াসেই ঢুকে পড়ল বিড়ালটা। আজ আবার দুধের হাড়িতে মুখ দিলনা তো? ভাবী তার বাপের বাড়ি থেকে বিড়ালটা আনার পর থেকেই শুরু হয়েছে, রোজ রোজ একই ক্যাচাল। আজ যে কারো তাড়া খেয়ে বিড়ালটা এখনও বের হয়ে আসছেনা! আজ মনে হয় কেস অন্য। গলার স্বর বাড়ছে, কমছে। বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। দোতালার জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম, না কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কজের মেয়ে রানীর ডাকে পিছনে ঘুরে দেখি বাবলু আর রানী দাঁড়িয়ে। বাবলু রানীর ওড়নার খুঁট ধরে আছে। রানী বলল ‘আপা দুধটা খাইয়া লন’। আমার জন্য দুধ, এসময়ে! মা, নিশ্চয়ই আজও বাবলুর দুধ থেকে ফের খানিকটা ঢেলে নিয়েছে। রানীকে জিগ্যেস করি, ‘কি হয়েছে রে আজ? বিড়াল যে দুধে মুখ দেয়নি সেটা তো বুঝলাম।’

‘রোজ রোজ কি আর দুধ বিড়াল খায় আপা। আইজ ভাবী ডাইলে লবন দেয় নাই, ভাতও নরম হইছে। বড় ভাইয়া রাগ কইরা ভাতে ডাইল ঢাইলা ফালাই দিছে।’

 ‘তারপর, আজ আর খাওয়া নাই?’

‘দেরি হইব। ভাবী বারান্দায় বইসা কানতাসে। আমারে আম্মায় ভাত চড়াইতে কইছে।’

‘আচ্ছা, তুই এখন যা। বাবলু থাকুক, ও খেলুক এখানে।’

দুধের মগটা এগিয়ে দিয়ে বাবলুকে বললাম, ‘বাবলু এটা খা। একদম ফেলবিনা, কেমন!’ সোনা মুখ করে বাচ্চাটা দুধটা খেয়ে নিল। ক্ষুধা লেগেছিল মনে হয়। তারপর দুধ দুধ গন্ধওয়ালা মুখে আমার গালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘মা যাই?’

‘আচ্ছা যা।’

ভাবীর কথা মনে হল। সেই বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে কিছু না কিছু ছুঁতোয় মা’র সাথে প্রতিদিন লেগে যাচ্ছে। আর ভাবীও আছে, বাপের বাড়ি গিয়ে দুটো দিনও থাকতে পারেনা। কিসের টানে যে ছুটে আসে? বাবা বউ হয়ে আসার পর ওর নাম দিলেন পম্পা। বহ্নি, ওর প্রিয় ডাকনামটা সেই থেকে হারিয়ে গেল। একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে চাকরি করত। বাবলু হবার সময় মেটারনিটি লিভ নিল, সবই চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু জয়েনিংয়ের সময়ে মা বলল আমার দাদু ভাই আর কটা দিন একটু বুকের দুধ খাক। ব্যাস ল্যাঠা চুকে গেল, ইমোশনাল ব্লাকমেইলিংয়ের চক্করে চাকরিটাও গেল। আমি বুঝি সব কিন্তু কি করব! কি এমন অসুখ আমার জানিনা। বাবা হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ছিলেন, উনি ওষুধ দিতেন, এখন ভাই প্রাকটিস করে, সেও ওষুধ দেয়, কিন্তু ভালো হলাম কই! সেই তো বিছানা থেকে মাথা তুলতে পারিনা, মাঝে মাঝে সেন্সলেস হয়ে যাই, প্রচন্ড অ্যানিমিয়া, শুয়ে বসেই দিন কাটে। ক্লাস সেভেন অব্দি স্কুলে গেছি। কোনমতে এস এস সি পরীক্ষা পার করেছি, এখানেই শেষ। তারপরও তো পাঁচ বছর চলে গেল। বাবা মারা গেলেন তিন বছর হতে চলল। কত ইচছা ছিল টিচার হব! সে যাক, দেখি একটু ওদিকে কি হল। রান্নাঘরে ভাবীকে দেখে উঁকি মারি, ‘বেশ সুঘ্রান, কী বানাচ্ছ?’

‘বেসনের হালুয়া।’

‘যাহ্, সেটা তো আর আমার পেটে সইবে না।’

ভাবী একটু হেসে বলল, ‘বাবলুর জন্য।’

ভাবীকে বলি, ‘আমার একটা কথা শুনবে?’

 ‘কি?’

‘সামনের মাসে বাবলুর চার বছরের জন্মদিন। ওকে একটা স্কুলে ভর্তি করে দাও আর তুমিও ঢুকে যাও।’

‘ইচ্ছা তো করে। কিন্তু বাসায় এত কাজ! আর কেমন কনফিডেন্স কমে গেছে।’

শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গেল। ‘সেটা বল। যে কাজটা রানী করলেও হয় সেটা ঘাড়ে নিয়ে সবার কথা শুনলে তো কনফিডেন্স থাকবেই না। কী দরকার ছিলো নুন ছাড়া ডাল রান্না করার?’

ভাবী প্রসঙ্গ পাল্টায়। ‘মিষ্টি দই বানিয়েছি, রাইস কুকারে। একটু দেই।’

‘তোমার দই তুমি খাও। দোকানে যেটা কিনতে পাওয়া যায় সেটা বাসায় বানাও কেন? যার যার কাজ তাকে করতে দাও। আর হ্যাঁ যেটা বললাম, চিন্তা করে দেখ।’ ভাবীর মুখটা নিচু হয়ে যায়। আমার কথায় একটু কষ্ট পেল হয়তো। পাক, সত্যিটা ওকে শুনতে হবে। পরে সরি বলে নেব। দেখি মা কী করে! মা তার সেলাই মেশিন নিয়ে বসেছে। মানে, মন যথেষ্ট ভার। রুমের দুই দিকেরই দরজা বন্ধ। বাবলুটা বারান্দার জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। আজ তার ভিতরে ঢোকা নিষেধ। বাবলুকে ডেকে নিয়ে আমি আবার আমার রুমের দিকে যাই।

ফুড়ুৎ করে সময় পাল্টে যায়, হয়ত মানুষও। ছয় মাস পরের এক সকাল। বাবলুকে নিয়ে ভাবী স্কুলে যাচ্ছে। সাড়ে বারটা নাগাদ আসবে। রানীকে ভাত, ডাল রান্না করে শাকটা কেটে রাখতে বলে। গত মাসে ছোট খালার ছেলের বউ স্কলারসিপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া গেছে। ছোট খালা গল্পে গল্পে মাকে বলেছে এ বছরের শেষে সেও নাকি অস্ট্রেলিয়া বেড়াতে যাবে। সেই থেকে মায়ের মন উদাস। তার ভাগ্যে আর এ সুখ হলো না! ভাইয়া অনেক করে বোঝালো স্কলারশিপ ছাড়াও বিদেশে বেড়াতে যাওয়া যায়। সেই সুবাদে আমার চিকিৎসাটাও যদি করানো যায়। তবে সেসব তো অনেক টাকার ব্যাপার। মাকে রাজি করিয়ে বাড়িটা রিয়েল স্টেটকে দেওয়ার জন্য ভাইয়া বেশ ছুটাছুটি করছে। কয়েক পার্টি এসে মাপজোকও নিয়ে গেছে। সুযোগ বুঝে ভাবীও এদিক ওদিক চাকরির চেষ্টা করছে। তার আত্মবিশ্বাসটা একটু একটু করে ফিরে আসছে, শিগরিরই কিছু একটা জুটিয়ে ফেলবে হয়তো। বাড়ির এ পরিবর্তনটা আমার খুব ভালোলাগে।

আর হ্যাঁ বিড়ালটা আজকাল আর দুধের হাড়িতে মুখ দেয় না। ভাবী যত্ন করে ওকে বাটিতে করে রোজ দুধ খেতে দেয়।