November 2, 2024
জীবনের গল্প

‘তৃতীয় লিঙ্গ’ নামে বিভ্রান্তি ও অবমাননায় আটকে কাদের জীবন?

শেখ সিরাজুম মুনিরা নীরা।। যাদের আমরা ডাকি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ব’লে, যারা মূলত হিজড়া হিসেবে পরিচিত, তাদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় চার বছর বয়সে। ছোটবোনটার জন্মের পর ওকে হাসপাতাল থেকে নানাবাড়ি আনা হলো, একদিন সকালে দেখি বাসার সামনে বিরাট হট্টগোল। পুরো পাড়া এসে জড়ো হয়েছে।  প্রচুর চিৎকার হচ্ছে। আমি ছোটমানুষ, কেউ আমাকে কিছু বলে না। আমি এদিক ওদিক ঘুরি আর দরজা বা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কিছু দেখা যায় কি না সেই চেষ্টা করি। আবার সবার মুখের মানচিত্র দেখে ভয়ও পাচ্ছি। অবশেষে যা বুঝলাম, বাসায় হিজড়ার দল এসেছে। ওরা আমার ছোটবোনকে কোলে নিয়ে নাচাতে চায়। আর তার বিনিময়ে চায় মোটা অঙ্কের টাকা। কিন্তু বাড়ির লোকজন তাতে রাজি না। প্রথমে এককথা দুইকথায় আপোষের চেষ্টা চলে। পরে শুরু হয় হিজড়ার দলের পক্ষ থেকে তুমুল গালিবর্ষণ। সেইসঙ্গে নানান ‘অশ্লীল’ অঙ্গভঙ্গী।

আমার নানা খুব ঠান্ডা মেজাজের মানুষ ছিলেন, এক পর্যায়ে তিনি মেজাজ হারান এবং তার আগ্নেয়াস্ত্র বের করে নিচে নামেন হিজড়ার দলকে ভয় দেখাতে। বলাই বাহুল্য তারা ভয় পায়নি।  তবে টাকা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয় কি না সেটি আমার আর মনে নেই।

সে সময় আম্মুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ওরা কেন এমন করে। আম্মু বলেছিল, ওদের মা হওয়ার শখ থাকলেও আল্লাহ তাদের সে ক্ষমতা দেননি। তাই অন্যের বাচ্চা কোলে নিয়ে নাচিয়ে আনন্দ করে। আর যেহেতু ওদের কেউ কাজ দেয় না তাই এর বিনিময়ে ওরা টাকা দাবি করে।  কিন্তু কথিত আছে যে, হিজড়ারা নাচালে বাচ্চা অসুস্থ হয়ে যায়।  তাই আমরা ওদের কোলে বাচ্চা দিতে ভয় পাই।

আমার ধারণা, দেশের বেশিরভাগ মানুষের হিজড়া সম্পর্কে প্রথম ধারণা এভাবেই আসে।  বড় হতে হতে সেই ধারণায় নানান পালক লাগে। যেমন, হিজড়ারা হাসির বিষয়, কোনো ছেলের মধ্যে কমনীয় ভাব থাকলে তাকে হিজড়া ডাকা যায়, কোনো মেয়ে শক্ত পোক্ত বা দীর্ঘ দেহের হলে তাকেও হিজড়া ডেকে মজা করা যায়, বন্ধুদের আড্ডায় কেউ একজন থাকে যে হিজড়াদের নকল করে নাচতে পারে, গাইতে পারে। এসব করে আসরও জমাতে পারে।

মোটকথা, হিজড়া সম্পর্কিত যা কিছু সমাজে সাধারণভাবে প্রচলিত তার ৯০ শতাংশই অবমাননাকর। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে নারী ও পুরুষের পাশাপাশি আরেকটি লিঙ্গকে স্বীকৃতি দেন। যাকে উল্লেখ করা হয় তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে।

মজার ব্যাপার হলো, এই হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা কিন্তু টুপ করে আকাশ থেকে পড়েন না। এরা আমাদের মতো পরিবারেই জন্ম নেন। কিন্তু জিনগত কিছু বৈশিষ্ট্য এদের আমাদের থেকে আলাদা বানিয়ে দেয়। আর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন সেই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পেতে থাকে তখন আমরা তাদের অচ্ছু্ৎ বলে গণ্য করতে শুরু করি।

এবার জেনে নিই কাদেরকে বলা হয় হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ। একদম সাদা বাংলায় যদি বলি তাহলে, কোন মানুষ যখন তার শরীরে ক্রোমোজোমের ত্রুটি নিয়ে জন্মায় তখন তার লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা যায়। আর তখনই তাকে তৃতীয় লিঙ্গের কাতারে ফেলা হয়।

যদি আরেকটু বুঝিয়ে বলতে হয় তাহলে বিষয়টা এরকম। ক্রোমোজোম দিয়ে মানুষের লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞান বইগুলোতে যেমন লেখা থাকে যে, মানুষের বংশগতির ধারক ও বাহক হলো ক্রোমোজোম।  একজন স্বাভাবিক মানুষের দেহকোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে। এর মধ্যে একজোড়া হলো সেক্স ক্রোমোজেম, যার কাজ হলো সেই মানুষটির লিঙ্গ নির্ধারণ করা। নারীর সেক্স ক্রোমোজোম জোড়া হলো XX আর পুরুষের সেক্স ক্রোমোজোম জোড়া হলো XY।  মা-বাবার মধ্যে মিলনের সময় যদি দুজনের এক্স ক্রোমোজোম মিলিত হয় তখন তাদের কন্যা সন্তান হয়। আর যদি মায়ের X এর সঙ্গে বাবার Y ক্রোমোজম মিলিত হয় তখন যে সন্তান জন্ম নেয় তার লিঙ্গ হয় পুরুষ।

কোনো কারণে যদি এই ক্রোমোজোমগুলোর অস্বাভাবিক বিন্যাস ঘটে তখন সেই শিশুর লিঙ্গ নির্ধারনে সমস্যা সৃষ্টি হয়।  যেমন, XX এর বদলে বিন্যাস হলো XXY কিংবা XY এর বদলে হলো XYY। ফলে দেখা যায়, কোনো মানুষের বাহ্যিক গঠন নারীর মতো, কিন্তু বয়ঃসন্ধির সময় তার ঋতুস্রাব শুরু হলো না। তখন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা গেল, তার ভেতরে নারীর নয় বরং পুরুষের জননাঙ্গের কিছু অংশ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সে দেখতে নারীর মতো হলেও, তার লিঙ্গ পরিচয়টি জটিল।

একইভাবে পুরুষ হিসেবে জন্ম নেওয়া একটি শিশুর শরীরের ভেতরে থাকতে পারে নারীর কোনো অঙ্গ বা বৈশিষ্ট্য।  বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটার ধরন, কথা বলা, গলার আওয়াজে প্রকাশ পায় যে তার ভেতরে আসলে রয়েছে নারীর বৈশিষ্ট্য।

উন্নত দেশগুলোতে জন্মের আগেই শিশুর লিঙ্গ পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। তাছাড়া সন্তান জন্মের পরও তারা নানানরকম পরীক্ষার মাধ্যমে এসব নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের মতো দেশে সে সুযোগ অবশ্য নেই।  ফলে যদি না কোন শিশু বাহ্যিক যৌনাঙ্গে কোনো অসঙ্গতি নিয়ে না জন্মায়, তাহলে একটা বড় সময় পর্যন্ত তার লিঙ্গ পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায় না।

সাধারণত দেখা যায়, কারও মধ্যে নারীর সব বৈশিষ্ঠ্য থাকলেও জননাঙ্গটিই নেই, একইভাবে পুরুষের সব বৈশিষ্ট্য থাকলেও পুরুষের জনন অঙ্গটি অনুপস্থিত। কারও কারও মধ্যে আবার নারী পুরুষ উভয়েরই বৈশিষ্ট্য থাকে। ফলে তারা দুই লিঙ্গের মানুষের মতো আচরণ করেন।

ইংরেজিতে এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় ইন্টারসেক্স। অন্যদিকে আরেকদল মানুষকে ভাগ করা হয় ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে। ট্রান্সজেন্ডার মানুষের বৈশিষ্ট্য হলো এদের শরীর নারী বা পুরুষের মতো হতে পারে। কিন্তু মন শরীরের বিপরীত আচরণ করে। মানে তাদের মনে হয়, তারা ভুল দেহে আটকা পড়েছেন।

আমাদের এই উপমহাদেশে ইন্টারসেক্স, ট্রান্সজেন্ডার দুইদলের মানুষকেই হিজড়া হিসেবে এক ছাতার নিচে ধরে নেওয়া হয়।

বিশ্বের অনেক দেশেই একটা নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে অস্ত্রোপচার করে লৈঙ্গিক ত্রুটি ঠিক করে ফেলার প্রচলন আছে। তবে এখন বেশ কয়েকটি দেশ বিষয়টি নিষিদ্ধ করেছে। কেননা, যখন একটি শিশুর অস্ত্রোপচার করা হয় তখন তাতে অনুমতি দেন তার বাবা-মা। শিশুটি অনুমতি দেওয়ার বয়সে থাকে না। পরবর্তীতে বড় হওয়ার পর সে কোনো শারীরিক বা মানসিক জটিলতায় পড়লে তার দায় চিকিৎসক বা বাবা-মায়ের ওপর পড়ে। সে কারণে, তৃতীয় লিঙ্গের অনেক মানুষই এই অস্ত্রোপচারকে এখন আর সমর্থন করেন না। তারা তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই বাঁচতে চান। তবে যখন কেউ স্বেচ্ছায় অস্ত্রোপচার করতে চায় তখন কেবল সেটিরই অনুমতি দেওয়া হয়।

একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সেক্স আর জেন্ডার শব্দ দুটির প্রায়োগিক অর্থ কিন্তু এক নয়।  নৃবিজ্ঞানে পড়াশোনার দরুন যেটকু জ্ঞান আমার আছে সে অনুযায়ী, সেক্স হলো ব্যাক্তির শরীরে লিঙ্গীয় পরিচয়। আর জেন্ডার হলো, নারী-পুরুষের সামাজিক-মনস্তাত্বিক বিষয়। মানে সেক্স দিয়ে আপনি নারী পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করতে পারবেন, কিন্তু তাদের সামাজিক পরিচয়, তাদের মধ্যকার সমাজ নির্ধারিত সম্পর্ক বলে দেবে জেন্ডার। মানে জেন্ডারের কারণে বা বলতে পারেন সমাজ নির্ধারিত নিয়মের কারণে নারীর মতো দেখতে মানুষেরা নারী হয়ে ওঠেন, আর পুরুষের মতো দেখতে মানুষেরা হন পুরুষ।

গোল বাধে তখনই, যখন পুরুষের মতো দেখতে মানুষের শরীরে লুকিয়ে থাকে নারীর বৈশিষ্ট্য বা নারীর মন কিংবা নারীর দেহাবয়বের কারও ভেতরে বাস করে একজন পুরুষ। সমাজ এই বৈপরিত্য মেনে নিতে পারে না বা চায় না। তখন এই বৈশিষ্ট্যের মানুষেরা পড়েন অকুল পাথারে। সমাজ তাদের স্বীকৃতি দেয় না, সংসার করা হয় না, পরিবার তাদের নেয় না।  তারা ভেসে বেড়ান। নিজেরা নিজেদের মতো মানুষের হাত ধরে বিকল্প জীবন গড়ে তোলেন, বেঁচে থাকার জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করেন।

আমার আম্মু যেমন বলেছিল, ওরা নিজেরা মা হতে পারে না তো, তাই অন্যের বাচ্চা কোলে নিতে চায়।

হয়ত কারও কারও জন্য সেটাও সত্য!

 

শেখ সিরাজুম মুনিরা নীরা: সাংবাদিক