November 2, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

পর্ব-৮: ‘সারাদিন ভালবাসলো, সন্ধ্যায় যৌনপল্লীতে নিয়া বেইচা দিয়া গেল’

শাহাজাদী বেগম পেশাগত জীবনে একজন উন্নয়নকর্মী, ১৮ বছর ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। উনি বাংলাদেশে যৌনকর্মী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষা, এইচআইভি ও এইডসসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষনার কাজ করছেন। এই কাজগুলোর জন্য তাকে দেশের যৌনপল্লীগুলোতে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে।  সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেই গল্পে রূপান্তর করে লেখা  হয়েছে “গুহান্তরাল”। আজ থেকে ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হবে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর অষ্টম পর্ব।।

টুটুল একদিন আগেই ময়মনসিংহে এসেছে। একই হোটেলের পাশের রুমটা সুরমার জন্য বুকিং দেওয়া ছিল। সুরমা রুমে এসে শাওয়ার নিলো। একটা ছোট্ট টেবিলে কফি তৈরির সবকিছু রাখা আছে, পানি গরম করতে দিয়ে ব্যালকনির কাঁচের দরজাটা খুলে দিল। এই পাশটা একদম ব্রহ্মপুত্র লাগোয়া। সুরমা কফির মগ হাতে নিয়ে ব্যালকনির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। বাতাসে ভেজা চুলগুলো উড়ছে। পশ্চিম দিকে সূর্য ঢলে পড়েছে। গোধূলীর আলোতে সবকিছু কেমন সোনারঙা লাগছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি গলে যাওয়া সোনার মত ঝিকমিক করছে। বেশ কয়েকটা নৌকা দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে শখে ঘুরতে বের হওয়া শহুরে মানুষেরা। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একদম নদের পাড়ে, মেডিক্যাল কলেজটা এখান থেকে একটু দূরে শহরে ঢোকার মুখে। সুরমার খুব ফ্রেশ লাগে। ভুমিকম্পে  ব্রহ্মপুত্রের মূল গতিপথ বদলে গেছে অনেক আগেই। এখন এটাকে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র বলে। নদের প্রস্থও কমে এসেছে, কমেছে নাব্যতাও। অবশ্য বর্ষাকালে তাকে ভরা যৌবনে ফুঁসে উঠতে দেখা যায়।

কফি শেষ হতেই মাগরিবের আজান পরে। সুরমা দরজা খোলা রেখে রুমে ঢুকলো। টিভির রিমোট হাতে নিয়ে দরজার কাছের সোফায় বসে পড়ে। এলোমেলো বাতাসে চুলগুলো বারবার চোখেমুখে পড়ছে। একহাতে চুল সরিয়ে আরেক হাতে রিমোট টিপে টিভি অন করে। স্থানীয় ডিশ চ্যানেলে হিন্দি সিনেমার গান দেখাচ্ছে, “টিপ টিপ বর্ষা পানি…।” সে আয়েশ করে বসে গানে মন দেয়। জর্জেট শাড়ি প’রে ভিজে চুপসে নায়িকার বিচিত্র ভঙ্গিতে নাচ, একটা সময় নায়কও ব্লেজার খুলে জামা-কাপড় ভিজিয়ে একই অঙ্গভঙ্গিতে নায়িকার সাথে নাচা শুরু করে। হিন্দি সিনেমায় যৌনতা যতটা দেখায়, পৃথিবীর আর কোন ভাষার সিনেমাতে তেমনটি দেখা যায় না। তবে বলিউডে যৌনতার যতটা শৈল্পিক উপস্থাপন, সেটিও বিরল দৃষ্টান্ত। সুরমার মাঝে মাঝে মনে হয় হিন্দি সিনেমার যৌন সুরসুরি দেওয়া উপাদানগুলো পর্নগ্র্যাফিকেও হার মানায়। গানটা শেষ হতেই স্থানীয় বিজ্ঞাপন শুরু হল “আগামী বৃহষ্পতিবার ময়মনসিংহ জেলার স্বদেশি বাজার যৌনপল্লীতে তাদের সংগঠনের সাধারন নির্বাচন। উক্ত নির্বাচনে সভানেত্রী পদে মিস জোছনা বেগম মোমবাতি মার্কায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। উনি নির্বাচিত হলে যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষায়  কাজ করবেন। উনি পল্লীর ভোটারদের ভোট এবং আপনাদের সকলের কাছে দোয়া প্রার্থী। প্রচারণায় জনাব আজমল হুদা, অধ্যাপক, সরকারি টিটি কলেজ। জোছনার একটা সাদাকালো পোস্টারে মোমবাতি মার্কার পাশে হাসিমুখে ‘ভি’ চিহ্ন দেখানো ছবি। সুরমা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, সে কি ঠিক দেখলো? সময় নেয় । স্থিতু হলে বুঝলো ও ঠিকই দেখেছে জোছনার নির্বাচনী প্রচারনা। যৌনপল্লী সংগঠনের নির্বাচনের একজন প্রার্থীর প্রচারনা এভাবে ডিশ চ্যানেলে প্রচার হচ্ছে এবং সকলেই দেখছে- বিষয়টা অবাক করে তাকে। সাধারন মানুষ এতটা সহনশীল, যৌনকর্মীদের প্রতি ইতিবাচক এটা পুরোপুরি বিশ্বাসও করতে পারছে না। কিছুটা দুশ্চিন্তাও লাগছে এটাকে ঘিরে না আবার দাঙ্গা তৈরি হয়। যাই হোক ভালো করে খোঁজ নিতে হবে। কিন্তু শুধু একজনের প্রচারণা হচ্ছে কেন?  অন্যদের কারো কথা বলছে না, সুরমার খটকা লাগে। আর এই অধ্যাপক কে, তার এখানে কী- এমন অনেক প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি দেয়।

প্রত্যেকটা যৌনপল্লীতে যৌনকর্মীদের একটি সংগঠন আছে। সেই সংগঠনের একটি গঠনতন্ত্রও আছে। সেটি সরকারি যে অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধনকৃত তাদের কাছ থেকে অ্যাপ্রুভ  করা। সেই গঠনতন্ত্র অনুসারে প্রত্যেক সংগঠনের একটি সাধারণ কমিটি থাকে ও একটি নির্বাহী কমিটি থাকে। এই নির্বাহী কমিটি সাধারণত ৭ থেকে ১১ সদস্যের হয়ে থাকে। নির্বাহী কমিটি শুরুর দিকে হাত তোলা ভোটে গঠিত হলেও এখন পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াতেই হয়ে থাকে। একজন নির্বাচিত প্রার্থী তার জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ দুই বার কমিটিতে থাকতে পারবে। বর্তমান কমিটি নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে সাধারন সভা করে সারা বছরের হিসাব নিকাশ ও কাজকর্মের প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে। সাধারণ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবেদন গৃহীত হলে বর্তমান কমিটি পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে এডহক কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে। এডহক কমিটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে (১০ দিনের মধ্যে) নির্বাচনী নীতিমালা অনুসারে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করবে এবং তাদের মাধ্যমে নির্বাচন দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করে তাদের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবে। স্বদেশীবাজার যৌনপল্লীর নির্বাচনও একই প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে। ৫ জনের ভিজিল্যান্ট টিমে সুরমাও আছে।

টুটুলের সাথে দেখা হল রাতের খাবারের টেবিলে। সুরমা জানতে চাইলো, ‘টুটুল, কী অবস্থা?’

– ভালো,আপা।

– নির্বাচনের প্রস্তুতি কেমন?

– বেশ ভালো।

– কেমন ভালো?

– আপা, এখন পর্যন্ত নির্বাচনী নীতিমালা অনুসারেই কাজ হচ্ছে। ৯টা পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ২০ জন। সভানেত্রী ও অর্থ সম্পাদক পদে ৩ জন করে প্রার্থী লড়ছে। দুই সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে, তাঁরা কাজ করছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সদর উপজেলার চেয়ারম্যান এবং সহকারি নির্বাচন কমিশনার জেলা সমাজসেবা অফিসার। গত সপ্তাহে এজিএম-এ এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে। দুই দিন পরে ওনারা আবার বসেন। মেয়েরা তখন ২শ’ টাকার বিনিময়ে নমিনেশন কেনেন। এনজিওদের সহায়তায় ফর্ম পূরন করে জমা দেন। ২৪টা ফরমের মধ্যে ৪টা বাতিল হয় ও ২০টা টিকে যায়। সাথে সাথে তাদেরকে মার্কাও দেয়া হয়।

৪টা বাতিল হয়েছে কেন? সুরমার প্রশ্ন।

– একজন সর্দার্নী ছুকরী বেচা-কেনার সাথে জড়িত থাকায় তার নামে মানব পাচারের কেইস আছে। আর ৩ জন আগে পরপর ২ বার কমিটিতে ছিল।

– নির্বাচন কমিশনে জেন্ডার বিষয়টি কি বিবেচনা করা হয়েছে?

– জি আপা,  উপজেলা চেয়ারম্যান পুরুষ এবং সমাজসেবা অফিসার নারী।

– একটা বিষয় দেখলাম, স্থানীয় ডিশ চ্যানেলে জোছনার নির্বাচনী প্রচারনা হচ্ছে, দেখেছেন?

– না তো, টুটুলের বিস্ময়।

-আজ দেখবেন, কাল বিষয়টা নিয়ে কথা হবে।

– জি আপা। হুমায়ূন ভাইয়ের এক আত্মীয় অসুস্থ, কাল ঢাকায় যেতে হচ্ছে তাই বিকালে আমাদের সাথে মিটিংটা হবে না।

– কখন যাবে?

– সকাল ১০ টায়

– ওনাকে সকালে আমাদের সাথে নাস্তা করতে বলেন। সেই সাথে মিটিংটা সেরে ফেলা যাবে।

– তাহলে তো ভালোই হয়। আমি ওনার সাথে কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি।

খাবার শেষে যে যার রুমে ফিরে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই টুটুলের মেসেজ, সকালের নাস্তায় হুমায়ূন ভাই ও তিতলী থাকবে। হুমায়ূন ভাই স্থানীয় সহযোগী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আর তিতলী এই প্রজেক্টের কোর্ডিনেটর। সুরমা পরের দিনের পরিকল্পনায় আরো দুটো এজেন্ডা যোগ করে ঘুমোতে যায়।

সুরমা ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠলো, কারন সে ভোর হওয়া দেখবে। একটা আলো-আঁধারিতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। এক ঝটকা ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শে শরীর-মন জুড়িয়ে গেল। সে বাম হাতে উঁচু করে বাঁধা খোপাটাকে খুলে ফেলতেই চুলগুলো পিঠের উপরে আছড়ে পড়ে। এই এক অভ্যাস ওর। বাতাস  হলেই চুল খুলে বাতাসের বিপরীতে দাঁড়াবে। এখনও সে বাতাসের বিপরীতে নদের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। আর সেই সুযোগে বাতাস চুলগুলোকে এলোমেলো করে পিছনের দিকে উড়াতে থাকে। সে হাতদুটো দু’পাশে পাখির ডানার মত মেলে ধরে। ৫ তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তার মনে হয় সে পাখি হয়ে উড়ছে।  এনজিওতে কাজ করে দুটো জিনিস তার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে –মানুষের খুব কাছে যাওয়া যায়, জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখা যায়। আরেকটি হল ট্যুর- অনেক জায়গায় যাওয়া যায়, প্রকৃতি দেখা যায়।  অল্পক্ষণেই অন্ধকার ভেদ করে আলো ফুটতে থাকে। আস্তে আস্তে নদ,  আশেপাশের গাছপালা সব স্পষ্ট হয়।

একেবারে তৈরি হয়ে রেস্টুরেন্টে নামে সকাল সাড়ে আটটায়। মঙ্গলবার সকালের কাজ শুরু হয় নাস্তার টেবিলে মিটিং দিয়ে। হুমায়ূন ভাই, তিতলী ও টুটুল মিনিট পাঁচেক আগেই এসেছিল। আলোচনাতে যৌনকর্মী সংগঠনের নির্বাচন মূল এজেন্ডা। কথা হয় নির্বাচন ঘিরে আশা আর আশংকা নিয়ে, সম্ভাব্য ঝুঁকি ও ঝুঁকি মোকাবেলায় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েও কথা হল। হুমায়ূন ভাই বললেন উনি শহরে না থাকলেও সব সময় খোঁজ রাখবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এই সময় সুরমা জিজ্ঞেস করে, ‘আজমল হুদা, সরকাররি টিটি কলেজের অধ্যাপক, কে?’

হুমায়ূন ভাই হেসে বলেন, ‘উনি সরকারি টিটি কলেজের অধ্যাপক হলেও যৌনপল্লীর ভিতরে তার ব্যাপক প্রভাব আছে। তার এখানে ধান্দাপাতি আছে, টাকা পয়সার বিষয়ও আছে।’

সুরমার পালটা প্রশ্ন, ‘জোছনার সাথে তার কী সম্পর্ক- ধান্দা না অন্যকিছু?’

‘এইটা ঠিক আমি জানিনা, খোঁজ নিয়ে জানাতে পারবো। তবে উপর মহলে তার অনেক যোগাযোগ আছে।’ হুমায়ুন ভাইয়ের উত্তর।

নাস্তা শেষে কফি খেতে খেতে বাজেট ভ্যারিয়ান্স রিপোর্ট নিয়েও আলোচনা করে ফেলে তারা।

হুমায়ূন ভাই ঢাকার পথে রওয়ানা হলে সুরমা, টুটুল আর তিতলী যৌনপল্লীতে যাবার জন্য গাড়িতে ওঠে। স্বদেশী বাজার যৌনপল্লী হোটেল থেকে খুব একটা দূরে নয়। তিতলী মেয়েটা বেশ চটপটে, সুরমার খুব পছন্দ হয়। সুরমা জিজ্ঞেস করে, ‘তিতলী, এখানে কাজ করতে কেমন লাগছে?’

– জি আপা, ভালো।

– মনে করেন আমি একজন নতুন ভিজিটর হিসাবে যাচ্ছি, এখন এই ব্রোথেল সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাইলে আপনি কী কী বলবেন আমাকে?

সুরমা হেসে তিতলীর দিকে তাকায়।

তিতলী মিষ্টি হেসে বলতে শুরু করে, সুরমার মনে হয় যেন তিতলী আবৃত্তি করছে- ‘ময়মনসিংহ রেল স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ড থেকে আধা কিলোমিটার দূরে শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে বানিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত যৌনপল্লীটি। কবে তৈরি হয়েছিল স্থানীয়রা এখন আর মনে করতে পারে না। ধারণা করা হয় যে বৃটিশ আমলে এটি তৈরি করা হয়। বানিজ্যিক এলাকা হওয়ার কারনে এটি অত্যন্ত ব্যস্ত এলাকা। প্রতিদিন হাজারো মানুষের আনাগোনা। কাজেই খদ্দেররা বেশিরভাগই এইসব ব্যবসার কাজে আসা মানুষ। আনুমানিক ৫৫.৫ শতক জমি নিয়ে গঠিত যার স্থানীয় বাজার মূল্য ২০ থেকে ২২ কোটি টাকা। এই পুরো জমির মালিক ১৩ জন। ১২০ জন বাড়ীওয়ালীর ২০৭টি ঘর আছে। যৌনকর্মীরা এইসব ঘর দিনচুক্তিতে ভাড়া দিয়ে বসবাস করে। এখন মোট ২৯২ জন যৌনকর্মী বাস করে।’

‘ওদের মধ্যে কতজন যৌনকর্মীর মেয়ে?’ সুরমা আবারো জিজ্ঞেস করে

‘৮ জন’, তিতলীর উত্তর।

– ওরা সকলে ভোটার? মানে সকলের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে?

– ৭১ জনের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে।

– যৌনকর্মীদের সন্তান কতজন?

– ৯৬ জন

– সকলে মায়ের সাথে ব্রোথেলেই থাকে?

– ৪৪ জন মায়েদের সাথে ব্রোথেলের ভিতরেই থাকে। বাইরে যারা থাকে তাদের মধ্যে ৩ জন কলেজে পড়ে।

কথা বলতে বলতে ওরা পৌঁছে যায়। ব্রোথেলের সামনে গাড়ি থেকে নেমে সুরমার চোখ ছানাবড়া! রাস্তা থেকে ব্রোথেলের ভিতরে ঢোকার মুখ পর্যন্ত গলিটা পুরা প্রার্থীদের ছবি ও মার্কা সম্বলিত পোস্টারে ছেয়ে আছে। একদম জাতীয় নির্বাচনের সময় আমাদের পাড়া মহল্লাগুলো যেমন হয় ঠিক তেমনই। পোস্টারগুলো দড়িতে বেঁধে এমন করে টাংগানো হয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে মাথার উপরে ছাদ। ওরা তিন জন সেই ছাদের ভিতর দিয়ে উপরের পোস্টারগুলো দেখতে দেখতে ভিতরে ঢোকে। ভিতরে ঢুকেও একই অবস্থা, প্রচুর পোস্টার চারিদিকে টাঙ্গানো, বাড়িগুলোর দেয়ালেও সাঁটানো। ছেলেপেলেরা মিছিল করছে, “ভোট চাই ভোটারের, দোয়া চাই সকলের।” পাশেই একটা নির্বাচনী বুথ করা হয়েছে। দুইজন যৌনকর্মী আর দু’জন ছেলে বসে আছে। ওদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এখানে কী হয়?’

‘এইখানে ভোটের তথ্য, ভোটারের তথ্য আছে। কে কোন পদে দাঁড়াইছে, কার কী মার্কা  আর কোন ভোটারের নম্বর কত সবকিছু এইখান থাইকা দেওয়া হয়। কে কেমনে ভোট দিবে সেইসবও দেখাইয়া দেই আমরা’, দুইজন যৌনকর্মী মিলে উত্তর দেয়।  সুরমার খুব ভালো লাগে। চারিদিকে কেমন উৎসবের আমেজ!

ভিতরে এনজিওগুলোর অফিস কাছাকাছি। ওরা প্রজেক্ট অফিসে গিয়ে বসে। আজ সুরমা নিজেদের মত করে নির্বাচনের প্রস্তুতি দেখবে, প্রার্থীদের সাথে কথা বলবে, ভোটারদের সাথে কথা বলবে। কাল এনজিওদের সাথে মিটিং, ভিজিল্যান্ট টিমের সাথে মিটিং, শেষ মুহুর্তে এডহক কমিটির সাথে শেষ প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলা। আর পরশুদিন নির্বাচন। নিজেরা টিমের সাথে কাজের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে। এমন সময় একজন ঢুকে লম্বা সালাম দিয়ে বলল, ‘আপা, আমি সাধারন সম্পাদক পদে দাঁড়াইছি, আমার জন্যে দোয়া করবেন।’

সুরমা আগে দেখেনি মেয়েটাকে, ২২-২৩ বছর হবে। তিতলী কিছু বলার আগেই সে হেসে বসতে বলে।

– কী নাম আপনার?

– নাজমা

-সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হলে আপনাকে কী কী দায়িত্ব আর কাজ করতে হবে?

– আপা, এইটা অনেক দায়িত্বের পদ। মিটিং ডাকা, সকল কাগজপত্র খাতা , ঠিক রাখা, মিটিংয়ের আলোচনাগুলা লিখে রাখা, এইগুলা সব দায়িত্ব আমার। আগের মিটিংয়ে কী আলোচনা হইছে, কী সিদ্ধান্ত হইছে সেইগুলার দেখাশোনাও আমার কাজ হবে। সভানেত্রীরে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য সহযোগিতা করাও আমার দায়িত্ব। ঠিক কইছি কিনা কন, আপা?

সুরমা মনে মনে চমৎকৃত হয়। মেয়েটার বয়স কম। সাধারণত সর্দার্নীদের দখলেই থাকে এইসব পদ। বলে, ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি লেখাপড়া জানেন।’

‘হ আপা, কেলাস সিক্স পর্যন্ত পইড়া বিয়া হইছিল। আপনারা যেইডারে কন বাইল্য বিবাহ। ভালই আছিলাম। খালি জামাইয়ের লগে থাকার সময় খুব ব্যাথা লাগতো। ডরে কইতে পারতাম না। কিছুদিন পরে তলপ্যাটে ব্যাথা শুরু হইলো। জামাইয়ের লগে থাকলে ব্যাথা বাড়ে। একদিন খুব ব্যাথা, সইতে না পাইরা কইছি, সে উত্তেজিত অবস্থায় আমারে এমুন মারলো। ঐ বাড়ির লোকজন কইলো প্রথম প্রথম এমুন হয়, বাচ্চা হইলে ভালো হইয়া যাইবো। বাচ্চা নেওয়ার জন্য জামাই  আমার সাথে বেশি বেশি থাকতো, আমি কষ্টে মইরা যাইতাম। খালি কানতাম, মায়রে কইছি। সেও কয় বাচচা হইলে ঠিক হইয়া যাইবো। এক বছর পরে পোয়াতি হই। সকলেই খুশি আছিলো। খালি আমার কষ্ট। প্যাটের ব্যাথা বাড়তেই থাকে। তার উপর খাইতে পারি না, শুকাইয়া কাঠ হইয়া গেলাম। আমি বাপের বাড়ি যাইতে চাই, জামাই যাইতে দেয় না। তার প্রত্যেক রাইতেই আমারে লাগে। আমার ব্যাথা আর কষ্টও বাড়তে থাকে। ৭ মাসের সময় এক রাইতে তার সাথে থাকার  সময় খুব ব্যাথা হইতেছিল। আমি না পাইরা জামাইরে কইতেই সে আমারে মারতে শুরু করলো। কইলাম প্যাটের বাচ্চাটার কথা মনে কইরা আমারে আইজকার মত মাফ করেন। আমার কথা শেষ হইতে না হইতেই প্যাটের উপর দিলো লাত্থি। আপাগো মনে হইলো মইরা গ্যালাম। এর পরেই শুরু হইলো রক্ত ভাঙ্গা, কি তাজা রক্তগো আপা! সারারাইত সে কাউরে  কিছু কইতে দিলো  না। পরে জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। জ্ঞান ফেরার পরে দেখি আমি হাসপাতালে। কিন্তু খুবই খারাপ অবস্থা, বার বার জ্ঞান হারাই। প্যাটের ভিতরের বাচ্চাডা মইরা গেলগো আপা। আমারে ইঞ্জেকশন দিয়া ব্যাথা তুইলা মরা বাচ্চাডারে বাইর করছে। আমি দ্যাখতেও পারলাম না। কি যে কষ্টগো আপা। আমার সাথে আমার মা আছিলো। ৭ দিন হাসপাতালে থাইকা কিছুটা সুস্থ হইয়া বাড়ি আসলাম। সকলেই চুপচাপ । কইলাম মায়ের বাড়ি যাবো। তারা যাইতে দিলো না। কিন্তু বুঝলাম কিছু একটা সমস্যা। কয়দিন পরে জানলাম আমি আর কোনদিন মা হইতে পারবো না। আমার জীবন শেষ হয়ে গেল। আরো তিন মাস পরে আমার জামাই আমারে কইলো শহরে একটা বড় ডাক্তার আইছে, তারে দেখাতে নিবে আমি  যেন মা হইতে পারি। আমি মহাখুশি হইলাম। আমার জামাই আমারে নতুন শাড়ি কিইনা দিলো। সেই শাড়ি পইরা খুব ভোরে  জামাইয়ের হাত ধইরা বের হইলাম। সে আমারে  শক্ত কইরা হাত ধইরা থাকলো সারাডা দিন, আমিও তার গা ঘেঁইশা থাকলাম। বিয়ার পর এই প্রথম আমি তারে ভালোবাসতে শুরু করলাম। সারাদিন আমরা বাসে, রিক্সায় গেলাম। দুপুরে শহরের হোটেলে খাইলাম। নদীতে নৌকায় নিয়া ঘুরলো। সন্ধ্যার আগখান দিয়া আমারে এই যৌনপল্লীতে নিয়া  বেইচা গেল!’

(চলবে)

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- পর্ব-২: খানকিগো আবার দাফন কীসের?

পর্ব-৩: টাঙ্গাইলের পুণ্যভূমিতে পাপীষ্ঠাদের আর জায়গা হবে না

পর্ব-৪: ‘ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?’

পর্ব-৫: ‘আমরা তো খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে’

পর্ব-৬: ‘পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা’

পর্ব-৭: ‘সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে’

পর্ব-৮: ‘সারাদিন ভালবাসলো, সন্ধ্যায় যৌনপল্লীতে নিয়া বেইচা দিয়া গেল’

পর্ব-৯: ‘‘এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই”

পর্ব-১০: “একজন খদ্দের না পাইলে ভাত পাবো কোম্মে”

পর্ব-১১: ‘আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলে আমার গা গোলায়!’

পর্ব-১২: “এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো”

পর্ব-১৩: “যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে কোন পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না”

পর্ব-১৪: টিকে থাকাই জীবন, বেঁচে থাকাই জীবন

পর্ব-১৫: যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধুরে মারল; এইসবের মইধ্যেও ওগো মাইয়া মাইনষের শরিল লাগে

শেষ পর্ব: আমার আকাশে পাখি হয়ে উড়বেন?