শ্যুগার ড্যাডি নয়, বুঝেশুনে সঙ্গী বেছে নিন
ইসমত আরা চৈতি।। নীরা মফস্বল শহর থেকে উঠে আসা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া উচ্ছল তরুণী। এদিকে স্কুলের সহপাঠী জাওয়াদের সাথে তার চার বছরের প্রেম। কিন্তু জাওয়াদ মায়ের ক্যান্সারের চিকিৎসার পেছনে সময় এবং পারিবারিক অর্থ ঢালতে গিয়ে এক সময় বুঝতে পারে, পাবলিকে পড়ার প্রস্তুতি নেবার সুযোগ তার নেই, অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আর্থিক সংগতি নেই। অগত্যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে সে পার্টটাইম জবে ঢুকে যায়। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যুল ক্ল্যাসি বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে নীরা বুঝতে পারে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কারো সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া বেমানান। যে কোন আড্ডায় বয়ফ্রেন্ড প্রসঙ্গ আসলেই নীরা হীনমন্যতায় ভোগা শুরু করে, অনেকে সামনা সামনিই বাঁকা ইংগিত দিয়ে যায়। নিশ্চয়ই নীরার রুচিবোধ খারাপ, কিংবা ছেলেটি তাকে আর্থিক সহায়তা দেয়, হয়ত তারা শারীরিক সম্পর্কে যুক্ত। দিনের পর দিন বন্ধুদের নাক সিটকানো আচরণে নীরার মন বিগড়ে যায়। নানা রকম মানসিক টানাপোড়েন, সম্পর্কে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত, বিচ্ছেদ পরবর্তী বিষন্নতায় ভুগতে শুরু করে নীরা। এরকম হাজারো নীরার মানসিক টানাপোড়েনের কারণ পার্টনার নির্বাচনে সামাজিকতার খেলো চাপ।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এদেশের মেয়েদের মগজে গেঁথে দিয়েছে, হোক স্বামী কিংবা বয়ফ্রেন্ড, তাকে মেয়েটির চেয়ে পড়াশোনা, ক্যারিয়ারের মাপকাঠিতে উচ্চতর স্থানে থাকতেই হবে। যাতে সেই পুরুষটি নিজের যোগ্যতা বলেই মেয়েটির উপর ছড়ি ঘুরিয়ে যাওয়ার সাহস পান বরাবর। এ ধরণের সম্পর্কে মেয়েটি ভালোবাসা যদিও বা পান, পারস্পারিক মননশীলতার পার্থক্যের কারণে সম্মান পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়ে। যোগ্যতার মাপকাঠিতে উঁচুতে থাকা পুরুষ সঙ্গীর কাছে মেয়েটি হয়ে পড়ে মর্জিরক্ষার পুতুল। তাকে ইচ্ছেমতো অবহেলা করা, ইচ্ছে হলেই দ্বিতীয় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, মেয়েটির লাইফস্টাইল ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা দেয়া, নিজের মতাদর্শ তার উপর চাপিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন রকমের টক্সিক আচরণ পুরুষসঙ্গীর কাছে ডালভাত হয়ে যায়। বেশিরভাগ নারীই সম্পর্কের তিক্ততায় জর্জরিত হয়ে মানসিক অবসাদে ভোগেন। আবেগতাড়িত হয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন না।
মুদ্রার ওপাশের দৃশ্যটিও প্রায় একই রকম। পুরুষকে যোগ্যতায় বড় হতে হবে – এই প্রথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কিছু নারী নিজের চেয়ে কম যোগ্যতা সম্পন্ন সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফলাফল হয় আরো টক্সিক। নিজের চেয়ে নারী সঙ্গীটি সামাজিক যোগ্যতায় উচ্চতর স্থানে থাকবেন, বেশিরভাগ পুরুষের জন্য এই তিক্ত ব্যাপার হজম করাই শক্ত। তারা হীনমন্যতার কারণে নারী সঙ্গীকে অহেতুক সন্দেহ করা, তার সফলতাকে সহজভাবে নিতে না পারা, তার ক্যারিয়ারে বাধা হয়ে দাঁড়ানোসহ নানান তিক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যান। কোনো নারী বাধ্য হয়ে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে চাইলে এরাই আবার চাপাতি হাতে দাঁড়িয়ে যান। কারণ নিজের চেয়ে বিদ্যাবুদ্ধিতে অধিক পারদর্শী নারীকে যুক্তিতে পরাস্ত করার ক্ষমতা তাদের নেই।
অথচ নারীর পুরুষ সঙ্গী নির্বাচনের মানদণ্ড হওয়া উচিত ছিল পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়া। যে মানুষটি আপনাকে নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে দেখেন, আপনার স্বপ্ন, আদর্শ, সিদ্ধান্তকে সম্মান করেন, নিজের স্বপ্ন পূরণেও অবিচল থাকেন, জীবনসঙ্গী হবার যোগ্যতা একমাত্র তারই। হোক সামাজিক যোগ্যতায় তিনি আপনার চেয়ে উচু কিংবা নিচু- মানসিক যোগ্যতায় ছাড় দেওয়া চলবে না। পাত্র সরকারি চাকুরিজীবী হলেই যে সংসার সুখের নাও হতে পারে তার প্রমাণ পত্রিকায় অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে চাকুরিজীবী নারী নির্যাতনের ভয়ে বেকার স্বামীর মাদকের অর্থ যোগান দিয়ে যাচ্ছেন এমন চিত্রও সুখকর নয়। সময় এসেছে নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার পাশাপাশি মানসিক সক্ষমতা অর্জনের দিকেও দৃষ্টি দেওয়ার। কেননা, গোটা শ্যুগার ড্যাডি কনসেপ্টটাই নারীবাদের সাথে সাংঘর্ষিক।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]