September 20, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ১সাহিত্যফিচার ২

যৌনতায় পিতৃতন্ত্রের ভণ্ডামি ও ‘পতিতা’র জীবন

নারীবাদ বোঝা ও বোঝাপড়া: পর্ব-১০

শারমিন শামস্।। পুরুষের বহুগামিতা ও যৌনতার ইচ্ছা অতি স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য। অন্যদিকে নারীকে বিয়ে পর্যন্ত তার কুমারিত্ব ধরে রাখতে হবে। সমাজ নারীকে চায় সতী হিসেবে। অন্যদিকে পুরুষের জন্য অভিধানে সতী শব্দের কোন অস্তিত্ব নেই। সমাজের চোখে পুরুষের যৌনতার ইচ্ছে ও তার প্রয়োগ অবাধ-স্বাধীন।

উনিশ শতকে এসে ব্রিটেনের নারীবাদীরা সমাজের এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নীতি কিংবা এই ভণ্ডামিকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করলেন। সমাজ নারীকে কুমারী ও সতী হিসেবে চায়। এদিকে কিছু নারীকে যৌনকর্মী হতে বাধ্য করে পুরুষের জন্য। সেই নারীদের তারা বলে পতিতা। পুরুষের পতিতাকে প্রয়োজন। এদিকে পতিতা হল সমাজের চোখে শয়তান (Social evil)। সমাজের গন্যমান্য নারীরাও তাদের ঘৃণা করে। এদিকে পতিতা ছাড়া সমাজ অচল।

সমাজের এই দ্বিচারিতা নারীবাদীদের চোখে ধরা পড়ল। তারা বললেন, সমাজের এই ভণ্ড নীতি নারীকে ভাল স্ত্রী এবং খারাপ মেয়ে- এই দু’ভাগে ভাগ করেছে। আর এই বিভক্তি পুরুষকে দিয়েছে নারীর ওপর খবরদারি করার সীমাহীন ক্ষমতা।

উনিশ শতকে ইউরোপের জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় যৌনবাহিত রোগের প্রকোপও বেড়ে গেল এক সময়। যেমন সিফিলিশ। আর ছড়াতে লাগলো লন্ডনের মত বড় বড় শহরগুলোতে। এই সিফিলিশের দায় চাপল শহরের পতিতাদের ওপর। তখন লন্ডনেই প্রায় আশি হাজার যৌনকর্মীর বাস।

যৌনবাহিত রোগ আটকাতে চালু হল শাস্তিমূলক আইন বানানোর কাজ। আর বলাই বাহুল্য শাস্তি নির্ধারিত হল নারীর জন্য, পুরুষের জন্য নয়। সুইডেনে ১৮৫৯ সালে পতিতাদের রেজিষ্ট্রেশনের পাশাপাশি সাপ্তাহিক স্বাস্থ্যপরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হল। ব্রিটেনে Contagious Diseases Acts বা CA Act নামে আইন পাশ হল ১৮৬৪-১৮৬৭ এর ভেতরে। সেই আইন অনুসারে ‘সাধারণ’ (common) পতিতা হিসেবে যে নারীকেই সন্দেহ হবে, তাকেই গ্রেফতার ও জোর করে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা যাবে। নারীটি যদি এতে আপত্তি জানায়, তবে রাষ্ট্রের ক্ষমতা থাকবে তাকে জেলে পুরে দেবার। আর স্বাস্থ্যপরীক্ষায় যদি তার রোগ ধরা পড়ে, তবে তাকে বন্দী অবস্থায় হাসপাতালে রাখা হবে নূন্যতম তিন মাস।

জোসেফিন বাটলার (১৮২৮-১৯০৬)

জোসেফিন ছিলেন ব্রিটেনের পতিতাবৃত্তিবিরোধী প্রথম অ্যাক্টিভিস্ট। তাকে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক এবং ইতিহাসের অন্যতম সাহসী নারীবাদী বলেও ডাকা হয়। নারীর পতিতাবৃত্তি এবং দাসত্বের বিরুদ্ধে নিরলস কাজ করে গেছেন তিনি। নিজের শিশুসন্তানের মৃত্যুর পর জোসেফিন নিজেকে সমাজকল্যানমূলক কাজে জড়িয়ে নেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাই করে গেছেন।

১৮৬৯ সালে জোসেফিন CA Act বাতিলের দাবি তুলে The Ladies’ National Association গঠন করলেন। তিনি বললেন, আইনটি অন্যায় এবং সেক্সুয়াল ডাবল স্ট্যান্ডার্ডকে প্রকাশ করে। এখানে পুরুষের হাতে শোষিত, ব্যবহৃত নারীটিকেই শাস্তি দেয়া হয়। মানে অত্যাচারিকে রেখে শাস্তি পায় অত্যাচারিত ব্যাক্তি, যেহেতু সে নারী। জোসেফিন এটাও বললেন, এই আইন নিম্নবিত্ত নারীকেও টার্গেট করে, ফলে আদতে এই আইন পতিতাদের তৈরি করছে একটা দাস শ্রেণি হিসেবে, যাদের কাজ পুরুষকে আনন্দ দেয়া।

জোসেফিনের সংগঠনের কাজে প্রভাবিত হয়ে ১৮৭৯ সালে গড়ে উঠল সুইডিশ ফেডারেশন। তারা এই আইনের বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকায় লিখতে ও বক্তৃতা দিতে শুরু করল। ১৮৮০’র দিকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে যৌনতায় নৈতিকতা নিয়ে তর্ক বিতর্কও শুরু হল। এর নেতৃত্বে ছিলেন নরওয়ের বিখ্যাত লেখক হেনরিক ইবসেন এবং সুইডেনের অগাস্ট স্ট্রিংবার্গের মত লেখকরা। স্ট্রিংবার্গকে ১৮৮৪ সালে কুখ্যাত ব্লাসফেমি আইনে অভিযুক্ত করা হয়। কেন জানেন? কারণ তিনি তার গেটিং ম্যারেড নামের ছোট গল্প সংকলনে নারীকে পুরুষের সমান বলে উপস্থাপন করেছিলেন!

সমাজের অভিজাত নারীদের কাছে সতীত্বের বা কুমারিত্বের বিষয়টি খুবই আকর্ষনীয় এক ট্যাবু  ছিল। তারা সমাজের দ্বিচারি চরিত্র নিয়ে আলোচনা করতেও রাজি ছিলেন না। জোসেফিনের সংগঠন LNA পতিতাবৃত্তির সাথে নিম্নবিত্তের সংশ্লিষ্টতার কথাও তুলে ধরছিল বারবার। সুইডিশ ফেডারেশন ও এলএনএ প্রানান্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছে বহু বছর ধরে। অবশেষে ১৮৮৬ সালে ব্রিটেন এই Contagious Diseases Acts বা CA Act বাতিল করে। ১৯১৮ তে সুইডেনে যৌনকর্মীদের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বিধি বাতিল হয়।

এরপর ১৯৭০ এ এসে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত নারীরা একত্রিত হতে শুরু করে, পতিতার বদলে নিজেদের পেশাগত নাম যৌনকর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে।

ইউরোপে পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে এভাবেই জেগে উঠেছিলেন প্রথম ওয়েভের নারীবাদীরা। এই আন্দোলন পরে বিস্তৃত হয়েছে। এখনও চলছে। তবু পতিতাবৃত্তি বন্ধ হয় নাই। পুরা বিশ্বে পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছে নারীর যৌন দাসত্বের ব্যবসা। আর সেই সেক্সুয়াল ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা যৌনতার বিষয়ে দ্বৈত মানসিক অবস্থান বা চর্চা ও অভ্যাস, তা এখনো বহাল রয়ে গেছে। বিশেষ করে আমাদের সমাজে। তাই নারীর যৌনতার খদ্দের পুরুষটি সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর যৌনকর্মী নারীটি সকলের ঘেন্নার। তাদের কবর হয়না। পতিতাপল্লীর বাইরে গেলে ঘেন্নায় লোকে মুখ ফিরায়ে নেয়। সমাজের অপছন্দের নারীকে ডাকা হয় বেশ্যা, হোর, খানকি ইত্যাদি নামে, যার অর্থ পতিতা। পতিতা মানে গালি। সমাজের এই ভণ্ড মানসিকতা ও অভ্যস্থতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন একমাত্র নারীবাদীরা। একমাত্র নারীবাদই নারীকে দিতে পারে মানুষের মর্যাদা ও অবস্থান।

 

[চলবে]