পুরুষকে তুষ্ট রাখতে নারী কেন সুন্দর থাকতে চায়?
মেহেরুন নূর রহমান।। আমি বিউটি পার্লারে যাই ভ্রু প্লাক করতে কিংবা চুল কাটতে। আগে নিয়মিত ফেসিয়াল করাতাম, এখন আর করা হয় না যখন থেকে জানতে পারলাম ফেসিয়াল আসলে তেমন উপকারী কিছু না। তবে ম্যানিকিওর, পেডিকিওর আমার খুব পছন্দের। যাই হোক, দেশে থাকতে আমার অফিস ছিল বনানীতে। বনানীর বেশ একটা নামকরা পার্লারে আমার নিয়মিত যাতায়াত হতো। ওখানে কাজ করা মেয়েগুলোর সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিলো। তাদের কাছে পার্লারে আসা নারীদের নানা গল্প শুনতাম। মাঝ বয়সী এক নারীর গল্প শুনেছিলাম, যিনি বেশ ধনী পরিবারের এবং প্রায় প্রতি সপ্তাহে আসতো নানা বিউটি ট্রিটমেন্ট নিতে। প্রচুর খরচ করতো বলিরেখা আর বয়সজনিত দাগ মুছতে। ওই নারী নাকি দুঃখ করে বলতো কিভাবে স্বামী তাকে অবহেলা করে শুধু বয়স বেশি হবার কারণে, আগের মত সুন্দরী না থাকার কারণে, আর সেই কারণেই সে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো বয়স ধরে রাখার। ওই নারীর স্বামী নিঃসন্দেহে মাঝবয়সী একজন পুরুষ এবং নারীটির চেয়ে বড়ই হবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ওই লোকের স্ত্রীর ভালোবাসা পাবার জন্য নিজেকে যুবক রাখার কোন দায় ছিল না ।
আমার এক প্রাক্তন সহকর্মীকে বলতে শুনেছিলাম যে তার স্বামী তার সাথে শারীরিক সম্পর্কে আগ্রহী নয় কারণ তার পেট বড়। বাচ্চা হবার পর উনি একটু মুটিয়ে গিয়েছিলেন। দেখতে যথেস্ট সুন্দরী হবার পরও আমার সহকর্মীকে নিজের ব্যাপারে হীনমন্যতায় ভুগতে দেখতাম। মজার ব্যাপার হলো আমি আমার সেই সহকর্মীর স্বামীকে চিনি এবং তার কিন্তু চমৎকার একটি ভুঁড়ি ছিল।
দেখতে ভালো অনেক নারীর মধ্যে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখেছি, কারণ তাদের স্বামীরা পদে পদে এটা অনুভব করতে বাধ্য করেছে যে তারা আর তরুণী নেই এবং তাদের আর আগের মত সৌন্দর্য নেই স্বামীকে ধরে রাখবার বা আকর্ষিত করবার। বলা বাহুল্য, এসব নারীর সবারই স্বামী মধ্যবয়স্ক এবং শরীর, স্বাস্থ্য, ফিটনেস, যুবকের মতন নয়। এসব স্বামীদের কিন্তু বয়সের কারণে সৌন্দর্যহীনতা নিয়ে কোন রকম হীনমন্যতা নেই।
আমাদের দেশে বিয়ের আগে থেকে মেয়েদেরকে সুন্দরী হতে হয় ভাল পাত্র পাবার জন্য। বিয়ের আগে মায়েরা তাদের মেয়েদের সুন্দরী রাখার কত আপ্রাণ চেষ্টা করে। হলুদ লাগাতে বলে, দুধের সর মাখতে বলে, রোদে বের হতে নিষেধ করে, শুধু এই কারণে যে সে যেন সুন্দরী থাকে এবং তার যেন একটি ভালো বর জোটে। মেয়েদের সুন্দরী হবার প্রচেষ্টা বর পাওয়া পর্যন্ত শেষ হয় না, বিয়ের পর বরকে ধরে রাখতেও তাদেরকে ক্রমাগত নিজেকে সুন্দর রাখতে হয়। বিয়ের আগে ভালো বর পাবার জন্য ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, রূপটান, উপটান আর বিয়ের পরও একই কাজ স্বামীকে বশে রাখার জন্য।
শুনলাম আমার ইউনিভার্সিটির বছর দুয়েকের ছোট এক দারুন সুন্দরী ছোট বোনের সংসারে স্বামীর পরকীয়া নিয়ে খুব অশান্তি হচ্ছে। যে আমাকে এই সংবাদ দিলো সে বিস্ময় প্রকাশ করে বলছিলো, ও এখনো কত সুন্দর আছে জানিস? ওর মত এতো সুন্দর একটা মেয়ের স্বামী কি করে পরকীয়া করতে পারে?
যেন অসুন্দর হলে মেয়েটির স্বামীর পরকীয়াটি গ্রহণযোগ্য হতো। আমরা ধরেই নেই স্ত্রীর বয়স এবং অসুন্দর হওয়ার সাথে যেন স্বামীর অবিশ্বস্ততা জড়িত। অত্যন্ত নোংরা এবং নিচু মনের ধারণা। এ কারণেই হয়তো বিয়ের পরও নারীরা নিজেদের সুন্দর রাখতে চায় স্বামীকে ধরে রাখার জন্য। অথচ আমি দেখেছি অনেক সুন্দরী নারীর স্বামীকে পরকীয়ায় জড়াতে এবং সেইসাথে দেখেছি অনেক তথাকথিত অসুন্দর নারীদের স্বামীরা তাদের স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত এবং স্ত্রীকে যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধা করে।
সুতরাং আপনি স্বামীর ভালোবাসা ধরে রাখার জন্য, স্বামীকে বিপথ থেকে ফেরানোর জন্য যদি মনে করেন সুন্দরী হলেই আপনি পার পেয়ে যাবেন তা কিন্তু নয়। যে করার সে করবে। সুন্দর অসুন্দর এগুলা বাহানা মাত্র।
আশির দশকে বিটিভিতে একটি টিভি সিরিয়াল হত। নাম মনে নেই তবে মনে আছে নাটকটিতে শাশুড়ি ছেলের বউদের বলছেন যে তারা যেন সেজেগুজে থাকে, না হলে তাদের বরদের মন অন্যদিকে চলে যেতে পারে। মনে আছে সেই সিরিয়ালের নারী চরিত্ররা সবাই কপালে টিপ পড়ে থাকত। তখন বোধ করি টিপ নিয়ে এখনকার মতো ধর্মীয় বাড়াবাড়ি ছিলো না। এই যে ছেলেদের অল্পবয়সী মেয়েদের সাথে বিয়ে দেয়ার প্রথা সেটাও সমাজের এই মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। অল্পবয়সী স্ত্রী মানে দীর্ঘদিন স্ত্রী যুবতী থাকবে এবং দীর্ঘদিন স্বামীকে মনোরঞ্জন করে যাবে। সমাজের সমস্ত নিয়ম কানুন যেহেতু পরুষদের তৈরি এবং পুরুষদের ভেবেই তৈরি, সেহেতু কিসে পুরুষের ভালো হবে, কিসে পুরুষের আনন্দ হবে এটাই প্রধান, নারী এখানে গৌণ।
আমার প্রথম সন্তান লন্ডনে আসার পর জন্মগ্রহণ করে। আমি যখন হাসপাতালে তখন আরেকটি দম্পতিকে দেখেছিলাম। স্ত্রীটি কালো এনং স্বামীটি সাদা। নারীটি তার তৃতীয় সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতাল এসেছিল। মধ্যেবয়স্ক ওই দম্পতির মধ্যে আমাদের দেশের সৌন্দর্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী স্বামীটি স্ত্রীর চেয়ে অনেক বেশি সুদর্শন ছিলো। স্বামীটি স্ত্রী’র প্রতি এত কেয়ারিং ছিল যে তা সকলের চোখে পড়তো। পরিচিত একজন (নারী) হাসপাতালে আমাকে দেখতে এসে এই দম্পতিকে দেখে খুব অবাক হয়েছিল। বলেছিল, স্বামীটি এত সুন্দর অথচ দেখো সাদামাটা স্ত্রীকে কি ভীষণ ভালোবাসে! আমি কিছুই বলিনি। বুঝতে পারছিলাম তার কাছে স্বামীর ভালোবাসা সৌন্দর্যের সঙ্গে যুক্ত, হয়তো ঘরে সে সেইভাবেই ট্রিটেড হয়।
নারী পোর্টালগুলোর বিভিন্ন লেখাতে দেখি কিছু পুরুষেরা কি কুৎসিত কমেন্ট করছে মাঝবয়সী নারীদের নিয়ে, তাদের সৌন্দর্য নিয়ে। তাদের কথায় বয়স্ক নারীদের দিকে আর কেইবা ফিরে তাকায়। তারা অসুন্দর, ফেলনা। এই মানসিকতার পুরুষরাই নানা বাহানায় মেয়েদের পেছনে ছোকছোক করে বা পরকীয়া করে। এসব পুরুষরা কখনোই নারীকে ভালবাসে না, তাদের কাছে নারী শুধুই ব্যবহারযোগ্য পণ্যমাত্র আর এদেরকেই খুশি করানোর জন্য নারীরা যখন আপ্রাণ নিজেকে সুন্দরী করার চেষ্টা করে তখন সত্যিই খুব হতাশ লাগে।
কেন সমাজ, পরিবার, প্রেমিক, স্বামী একটি মেয়েকে বারবার মনে করিয়ে দেবে তুমি সুন্দর না এবং তা নিয়ে মেয়েটি হীনমন্যতায় ভুগে সুন্দরী হবার জন্য উঠেপড়ে লাগবে? দীর্ঘ দাম্পত্যের পর, সুখে দুখে পাশাপাশি থাকার পর যে স্বামী শুধু আপনি মুটিয়ে গেছেন বলে বা আপনার মুখে বয়সের দাগ পড়েছে বলে অন্য কোন নারীর দিকে ঝুঁকে পড়ে সেই স্বামী কি আদৌ আপনাকে কখনো ভালোবেসেছিল? যে ভালোবাসা শারীরিক সৌন্দর্যের কাছে বাঁধা সে সত্যিকারের ভালোবাসা নয়। যে স্বামী আপনার বয়সজনিত সৌন্দর্যহীনতার দোহাই দিয়ে পরনারীতে আসক্ত হয়, বিশ্বাস করুন, তারা আপনি সুন্দরী হয়ে ফিরে আসলেও একই কাজ করবে। এসব তাদের অসৎ কাজকে জাস্টিফাই করার বাহানা মাত্র।
প্রিয় নারীরা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপিয়ে দেয়া পুরুষদের জন্য সুন্দর থাকার বোঝা মাথা থেকে ফেলে দিয়ে আত্মবিশ্বাসী হোন। কাউকে তুষ্ট করার জন্য নয় নিজের জন্য নিজের যত্ন নিন, নিজেকে সুন্দর রাখুন। আর এই আত্মবিশ্বাসের জন্য যেটা দরকার সবচেয়ে বেশি সেটা হচ্ছে পড়াশুনা করা এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়া। নারীরা পুরুষের উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল হতে হতে মানসিকভাবে এতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যে পুরুষরা সহজেই নানা ধরনের নোংরা খেলা তাদের সঙ্গে খেলতে পারে। নারীরাও বোকার মত সেই খেলার গুটি হয়।
আপনার বয়েস যাই হোক না কেন নিজের মনমত সাজবেন। বয়েস বাড়লে নিজের যত্ন একটু বেশিই করা উচিত তাই নিজের সঠিক যত্ন নিবেন, রূপচর্চা করবেন, বাড়তি মেদ ঝরিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করবেন। আর যে কোন বয়েসেই স্বামীর জন্য আপনি নিজেকে সাজাতেই পারেন, যেমন স্বামীও পারে স্ত্রীর জন্য নিজেকে সাজাতে। ভালোবেসে একজন আর একজনের কাছে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতেই পারেন। কিন্তু ব্যাপারটা যদি একতরফা হয় এবং স্বামীকে বশে রাখার জন্য বা বিপথগামী না হবার জন্য যদি আপনি যদি নিজেকে সুন্দর রাখতে চান তাহলে তা অসম্মানের।
মনে রাখবেন প্রত্যেকে নিজের মত করে সুন্দর। প্রত্যেক বয়সেরই আলাদা একটি সৌন্দর্য আছে। সৌন্দর্য একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। দেশ-স্থান-কাল ভেদে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা ভিন্ন হয়। আমার চোখে যা সুন্দর আরেকজনের কাছে তার অসুন্দর হতেই পারে। ঐশ্বরিয়া রায়ের মতো যে বিশ্বসুন্দরী, তার সম্বন্ধেও বলতে শুনেছি অনেকের নাকি তাকে ভালো লাগে না। আপনার নিজস্ব যে সৌন্দর্য আছে তাকে খুঁজে বের করুন। নিজেকে এতটা আত্মবিশ্বাসী করে তুলুন যে আপনাকে নিয়ে অন্যের বলা কথায় আপনি যেন হীনমন্যতায় না ভোগেন। আপনি যত হীনমন্যতায় ভুগবেন ততো আপনাকে নিয়ে এই খেলা চলতেই থাকবে। একমাত্র আপনিই পারেন আপনাকে নিয়ে এই গুটি খেলা বন্ধ করতে।
পরিশেষে বলি, নিজেকে শ্রদ্ধা করতে শিখুন, ভালোবাসতে শিখুন এবং আত্মবিশ্বাসের সৌন্দর্যে ঝলমল করুন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]