পাত্রী চাই!
প্রতিমা সরকার।। কিছু দিন আগে বাংলা দোকান থেকে আনা বাংলা পত্রিকা পড়ছিলাম, হঠাৎ একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেল, যেখানে পাত্রী চাই শিরোনামে ‘সুপ্রতিষ্ঠিত, উচ্চশিক্ষিত সঙ্গতকারনে বিবাহ বিচ্ছেদপ্রাপ্ত ৪৮ বছর বয়সী’ হিন্দু পাত্রের জন্য ‘যে কোন বর্ণের ত্রিশোর্ধ, সুন্দরী, শিক্ষিতা, মার্জিত, সংসারী’ হিন্দু পাত্রী চাওয়া হয়েছে। বিজ্ঞাপনে এটাও ছিল ‘নির্ঝঞ্ঝাট বিধবা/বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া পাত্রী গ্রহণযোগ্য’।
সবই ঠিক আছে। একজন উচ্চশিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত পাত্র উপরে উল্লিখিত বিষয়াদি চাইতেই পারেন। কিন্তু খটকা লাগলো ‘নির্ঝঞ্ঝাট বিধবা’ কথাটায়। কথাটার মানে কী? বিধবা হলেও সমস্যা নাই কিন্তু কোন সন্তান থাকা চলবে না! অবশ্য তিনি নিজে সন্তানের জনক কিনা তা উল্লেখ নেই কোথাও।
বরাবরই দেখি যে,আমাদের সমাজে এই ‘বিয়ে’ নামক সামাজিক প্রথাটায় পাত্র নিজে বা পাত্র পক্ষ বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন।সব সময় দেখেছি কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার অবস্থান অনেক নাজুক। বিয়ের কন্যা শিক্ষা দীক্ষায় যতই পাত্রের সমকক্ষ হোক না কেন, সমাজ ব্যবস্থা এমন ভাবে তৈরি করে রাখা হয়েছে যে, পাত্রী পক্ষের মাথা অবনত করেই থাকতে হয়।আর পাত্রী যদি বিধবা অথবা ডিভোর্সি হয় তাহলে ত আর কথাই নেই।
আমার এক দুঃসম্পর্কের মামা আছেন, তার স্ত্রী মানে আমার মামী কয়েক বছর আগে গলার ক্যান্সারে মারা যান। মামা মামীর ছয় মেয়ে। মামী যখন মারা যান তখন অলরেডি তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে নাতি নাতনি হয়ে গেছে। বাকি তিনটির মধ্যে দুটির জন্য পাত্র দেখা চলছে। কিন্তু দেখা গেল বছর ঘুরতেই মামা আবার বিয়ে করার জন্য পাত্রী খোঁজা শুরু করলেন। অজুহাত হিসাবে বললেন, উনার দেখাশোনা ঠিক মত হচ্ছে না। উনার ঠান্ডা খাবার খেতে হয়, খাবার সময় সামনে বসে কেউ বাতাস করে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
যথারীতি পাত্রী খোঁজা শুরু হলো। অবাক হয়ে দেখলাম মামার জন্য পাত্রীরও অভাব হচ্ছে না। আমার মাও দেখলাম সে সময় মামার জন্য দু’একটা পাত্রীর খবর আনা নেওয়া করছেন। যদিও আমার মা মামার বাসায় গেলেই বোনগুলো মাকে বলতো, ‘পিসিমনি বাবাকে বলো না, যেন আবার বিয়ে না করে। আমরা বাবার অনেক যত্ন করবো।’ মা কথা প্রসঙ্গে কয়েকবার তা মামাকে বলার চেষ্টাও করেছে, কিন্ত কে শোনে কার কথা।
একদিন মাকে ফোন দিয়েছি। একথা সেকথার পর মামার প্রসঙ্গ আসলো। মাও জানালো এই পর্যন্ত মামা কয়টি পাত্রী দেখেছেন। কে, কী বলেছে এসব। তখন আমার মাকে বললাম, আচ্ছা মা ধরো মামীর জায়গায় যদি মামা মারা যেতেন, তাহলে কি তুমি মামীর জন্য পাত্রের খোঁজ করতে? মা বলে, কী বলিস, তোর মামীর বিয়ে? তা কি হয় নাকি? বললাম, কেন নয়? মামা যদি এই বয়সে তিনটি বিয়ের যোগ্য কন্যা রেখে আবার বিয়ে করতে পারেন শুধুমাত্র উনার সেবা যত্ন ঠিক মতো হচ্ছে না বলে। তাহলে মামী কেন আবার বিয়ে করতে পারবে না? আমার মা বললেন, আমি বুঝতে পারছি তুই কি বলতে চাইছিস। কিন্তু মা ,আমাদের সমাজ এটা মেনে নেবে না।সবাই ছি ছি করবে। বললাম, ঠিক ধরেছো মা, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এমন সব প্রথা, নিয়মকানুন তৈরি করে রেখেছে যেখানে একজন পুরুষ দুই/চারটা বিয়ে করলেও কোন সমস্যা নেই। তিন/চার সন্তানের জনক বিপত্নীক, বিয়ে বিচ্ছেদপ্রাপ্ত হলেও সমস্যা নেই। সমস্যা যত সব মেয়েদের বেলায়।
এই বাতচিতের পরে আমার মা অবশ্য আর মামার জন্য পাত্রী খোঁজ করেননি।
একজন নারীর যদি স্বামী মারা যায় বা কোন সংগত কারনে ডিভোর্স হয় তাহলে তার দ্বিতীয় বিয়ের কথা কেউ ভাবতেই পারেন না। যদি তিনি নিঃসন্তান হন, তাহলে হয়ত একটা বর জুটে যেতেও পারে। তবে সেটি হবে এমন একজনের সাথে যার হয়ত বৌ মরে গেছে বা আগের বৌয়ের সন্তান হচ্ছে না, কিংবা অন্য কোন সমস্যা আছে। মোট কথা কোন অবিবাহিত পুরুষ সেই বিধবা/ডিভোর্সী নারীকে বিয়ে করবেন না বা বিয়ে করার মত উপযুক্ত মনে করবেন না। কিন্তু একজন পুরুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি বিপত্নীক হোন, সন্তানের বাবা হোন, বয়স্ক হোন, কোন ব্যাপার না, তার জন্য অবিবাহিতা মেয়েরও অভাব হবে না। কোন কোন ক্ষেত্রে যদিও বা কোন অবিবাহিত ছেলে সন্তানসহ কোন মেয়েকে বিয়ে করতেও চান তাহলে সেক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান ছেলেটির পরিবার।
আমার পরিচিত একটি মেয়ে তার দুটি সন্তানসহ টরন্টোতে থাকে। স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন হলো। মেয়েটি স্বাবলম্বী, দেখতে সুন্দর। তো তার ফেসবুকে একটি ছেলের সাথে পরিচয় হলো, ছেলেটিও ডিভোর্সী। এক মেয়ের বাবা। যদিও মেয়ে তার সাথে থাকে না। যাই হোক, দুজনের মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠার এক পর্যায়ে মেয়েটি বিয়ের কথা তুললে ছেলেটি একদিন জানায় যে তার মা রাজী হচ্ছে না এই বিয়েতে। কেন? কারণ মেয়েটির বাচ্চা আছে।
আবার দেখা যায় যে, কারো ভাইয়ের বৌ কিংবা বোন যদি মারা যায় বা বিয়ে ভেঙ্গে যায় তাহলে ভাই বা বোনের জামাইয়ের আবার বিয়ের ব্যাপারে আমাদের উৎসাহের কোন কমতি থাকে না। কিন্তু যদি ভাই মারা যায় কিংবা বোনের স্বামী মারা যায় তাহলে আমরা কি কখনো নিজের বোন বা ভাইয়ের বৌটির আবার বিয়ের কথা ভাবতে পারি? যদি কেউ ভেবেও থাকেন তাহলেও সেখানে সন্তান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। নারীর বেলায় বলি, এই সন্তানের দিকে চেয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দাও। আর বিয়ে শাদী করে কাজ নেই বাপু। কিন্তু দেখা যায় পুরুষের বেলায় এই সন্তান দেখাশোনার নাম দিয়ে পুরুষটিকে আবার বিয়ে করানোর জন্য উঠে পড়ে লাগি। হায়, কি বিচিত্র আমাদের মন!
আমার ছোটবেলার এক বান্ধবীর স্বামী মারা যায় খুব অল্প বয়সে। বান্ধবীর বাবা বেঁচে নেই। ভাইয়ের সংসারে এক ছেলে নিয়ে থাকে। কয়েক বছর আগে দেশে গেলে পর দেখা হয়েছিল। জিজ্ঞেস করলাম আবার বিয়ে করেনি কেন? এখন তো হিন্দু মেয়েদেরও দ্বিতীয় বিয়ে হচ্ছে। বলল, ভাই মা রাজী থাকলেও বৌদি রাজী ছিল না ননদিনীর আবার বিয়ের ব্যাপারে। তাছাড়া ছেলে আছে, দ্বিতীয় স্বামী বান্ধবীর দায়িত্ব নেবে, ছেলের কেন? অথচ ব্যাপারটা উল্টো হলে দেখা যেত কোন বিপত্নীক কিংবা ডিভোর্সী ভদ্রলোক দুই চারটা সন্তানসহই কোন অবিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করতে পারছেন অনায়াসে। কেউ বলছেন না, কেন বাপু, সন্তানের দায়িত্ব কেন নিতে হবে? কি অদ্ভুত!
অদ্ভুত হলেও এই বৈপরীত্যের ধারাই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। আর শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, আমরা সবাই তা মেনেও নিচ্ছি। এই অচলায়তন ভাঙ্গবে, এমন মানুষ কই?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]