September 20, 2024
মুক্তমত

মূর্খ না থেকে মস্তিষ্কের তালা নিজেই ভেঙ্গে ফেলুন

সাদিয়া মেহজাবিন।। কিছু বছর আগে গিওভানি বোকাচিও’র ডেকামেরন পড়েছি। করোনার এই মহামারীতে একটু শান্তির জন্যে আবার পড়তে বসলাম। তখন যেমন হাজারো প্রশ্ন আমার মনে উঁকি দিয়েছে, এখনো তেমন আমি হাঁসফাঁস করছি কেন আমরা নারীরা এখনো নিজেদের শিকল নিজেরাই খুলে ফেলে দিয়ে উন্মুক্ত হচ্ছি না? ভাববেন না ডেকামেরন কেবল নারীর মুক্তির বই। ডেকামেরন সামগ্রিক এই সমাজের এক রূপ নিয়ে আমাকে ভাবিয়েছে। ডেকামেরনের গল্প প’ড়ে ভেবেছি আমরা এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও কেন এত গোঁড়া? যে গল্প প’ড়ে আমি ভেবেছি তা আপনাদেরকে জানাতে চাই, যেন আপনাদের মনেও প্রশ্ন আসে। গল্পের কিছু অংশ আমি তুলে ধরছি।

রানিমা গল্প বলা শুরু করেছে, “কেবল দেহচর্চা করে, স্বভাবে এক চুল পরিমাণ পরিবর্তন না এনে যারা ভাবে তারা জ্ঞানী তারা আদতে মূর্খ। জ্ঞান অর্জন না করে কেবল মুখে আলগা প্রলেপ দিয়ে, অলংকার দিয়ে সাজালেও তাদেরকে কিছু জিজ্ঞেস করলে তারা বোবার মত দাঁড়িয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে তাদের এই আচরণকে তারা মনে করে সহজ সরল মনের পরিচয়। কিছু মেয়ের ধারণা তাদের কেবল কথা বলা উচিত চাকরানি কিংবা ঘরের মানুষদের সাথে। ফলে বাইরে গেলে তারা হোঁচট খায়। তারা বুঝে ওঠে না স্থান কাল পাত্রের হিসাব। তাই সহজে অপমানিত হয়।”

আমার এই গল্পের অংশ ভালো লেগেছে। নারীর কাজ কেবল বাচ্চা জন্মদান আর ঘরের লক্ষ্মী হয়ে থাকা আসল কাজ নয়। নারী যদি নিজেই নিজের মুক্তি না চায় কেউ তাকে মুক্তি দিতে পারবে না। বরং আমাদের এই সমাজ তাকে হেয় করবে।

আমি এমন কিছু নারী দেখে অবাক হই যারা খুব শ্রম দিয়ে পড়াশোনা করে শুধুমাত্র একটা ভালো বিয়ের জন্যে। আমাদের এই সমাজে নারীর বিয়ে খুব জরুরি নানা কারণে। কিন্তু খারাপ লাগে যখন দেখি বিয়ে করে অনেকে অন্যের উপর নিজেকে ছেড়ে দেয়।

আপনার মনে কি একবারও প্রশ্ন জাগেনি, এত শ্রম দিয়ে তবে ওই বই খাতা কাগজ কেনার কী দরকার ছিল? পড়ালেখা না করেও অল্প বয়সে বিয়ে করে জামাইর ঘর করলে পারতেন।

যারা কেবল রূপ নিয়ে আছে তাদের কাছে তাদের কথা ভাবি মাঝে মাঝে। সারাদিন কেবল রূপের তেলেসমাতি করে অন্যের কাছে নিজেকে কী হিসেবে প্রমাণ করতে চাই আমরা? রূপ নিয়ে পুরুষের সামনে গিয়ে নিজেকে পণ্য বানানোর প্রয়োজনীয়তা কোথায়? আর কেন এমন করবেন? এক্ষেত্রে বঙ্কিমের একটা কথা না বললেই নয়, “রূপজ মোহ ক্ষণস্থায়ী, গুণজ মোহ চিরস্থায়ী।” আমরা নিজেরাই যদি আমাদের গুণের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত না করে অন্যের কাছে নিজেকে কেবল পণ্য হিসেবে রাখতে চাই, তখন পুরুষ এসে আপনাকে মারধোর করলে, সম্মান না দিলে প্রতিবাদ করবেন কোন্ সাহসে? শিক্ষাকে আপন করে নেওয়াই কি বুদ্ধিমতীর পরিচয় না?

সেদিন পেপারে শেরিল স্যান্ডবার্গের একটি লেখা পড়ছিলাম। তিনি বলেন, “নারীরাই নিজেদের প্রধান অন্তরায় এবং একটি সময়ের পর তারাই আর এগোতে চায় না।” খেয়াল করলে দেখবেন অনেক নারী বলে অমুক কারণে আমার পড়াশোনা বা চাকরি বা কেরিয়ার হয়নি। এখন একটু মাথা খাঁটিয়ে দেখুন তো আসলেই কি কোনো উপায় ছিল না?

অন্ধকারের মাঝেও আশার আলো হাতে চলেছে আঁধারের যাত্রী। চোখ খুলে দেখুন, দেখতে পাবেন। কোনদিন যদি চোখই না খোলেন তাহলে দেখবেন কীভাবে? কীভাবে আফসোস করবেন যে- দেখিনা, এটা ওটা দেখিনি! যে ঘুমের ভান করে তাকে জাগানো যায় না। তাহলে নারীর মস্তিষ্কেরের কীট, তালা ভাঙ্গবে কে? এই কাজ আমরাই যদি না করি তাহলে কেউ করবে না।

খেয়াল করে দেখুন পুরুষরা যাই করুক তারা কিন্তু তাদের একটি ভাবনার দুনিয়া বানিয়ে ফেলেছে। বাচ্চা নেবেন তাদের ইচ্ছায় কিন্তু পালবেন আপনি, আর তারা বসে বসে ভাবনা চিন্তা করে নিজের আখের গুছিয়ে নিয়ে সব জায়গায় নিজের জয়ধ্বনি প্রতিষ্ঠা করবে। এ আমাদের কেমন বোকামি আর হাস্যকর যাপন, নিজেই ভাবুন। তাই এই সময়ের বুদ্ধিমতির কাজ নিজের মস্তিষ্কের তালা নিজেরাই ভেঙ্গে চুরমার করে দেওয়া।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]