November 3, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

“একটু অ্যাডজাস্ট করে নিলেই হয়ে যাবে!”

তাসনিয়া আল সুলতানা।। অনেকসময় প্রেমের সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে আমরা দেখি প্রেমিক প্রেমিকাকে কারণে অকারণে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। গালিগালাজের অসংখ্য শব্দগুলোর মধ্যে কমন একটি শব্দ থাকে, যেটাকে ভদ্র বাংলা ভাষায় বলা হয় ‘‘পতিতা”। আর অভদ্র বাংলাতে কি বলে সেই আলোচনা নাই বা করলাম।  এমনকি অনেক বিয়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি পান থেকে চুন খসলেই স্বামী স্ত্রীর জাত-চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ে। এখন অনেকে বুলি ছুড়বেন যে এসব আচরণ বস্তি কিংবা মফস্বল এলাকাতে যেখানে মেয়েরা কম শিক্ষিত বা শিক্ষার আলো যাদের কাছে পৌঁছেনি তাদের সাথেই ঘটে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, যে মেয়েটি উচ্চশিক্ষিত, ভালো কোনো পেশার সাথে জড়িত, সে মেয়েটিও স্বামী কিংবা প্রেমিকের এ ধরণের হীন আচরণ থেকে রেহাই পায় না। এবং আরও অবাক করা বিষয় হলো সেই উচ্চশিক্ষিত মেয়েটি দিনের পর দিন স্বামী কিংবা প্রেমিকের এসব আচরণ মুখ বুজে সহ্য করে যায়।

অবশ্য এর পেছনে একটি সামাজিক প্রেক্ষাপট দাঁড় করাতে হয়। সেটা হল দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পিতৃতন্ত্র। আমরা যারা নব্বই দশক কিংবা এর আগে জন্মগ্রহণ করেছি, আমরা দেখেছি কীভাবে আমাদের মায়েদের বারবার তাদের স্বামীর কাছে কিংবা শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের দ্বারা হেনস্থা হতে হতো। খাবারে একটু লবণ কম হলে অপমান-অপদস্ত হওয়া ছিল মায়েদের নিত্যসঙ্গী। তখনকার মায়েরা আগ বাড়িয়ে পারিবারিক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে তাদের শুনতে হতো “এসব তোমার কাজ নয়।” অথবা স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করলে তাদের ইচ্ছার কোনো দামই থাকতো না, কারণ ঘরের কর্তা তো আছেনই পরিবারের চাহিদা যোগানের জন্য! স্ত্রীর এক্সট্রা ইনকামের কী দরকার? সারাদিন গাধার মতো খাটুনির পর দিন শেষে মায়েদের শুনতে হতো ‘‘সারাদিন ঘরে বসে করোটা কি?’’ অথবা ‘‘সামান্য পরিবার সামাল দিতে না পারলে এখানে থাকার দরকারটা কি?’’

এসব দেখে শুনেই আমাদের শৈশব, কৈশোর কেটে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে মায়েদের প্রতি এমন একরোখা আচরণ দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই তাদের প্রতি এসব আচরণ খুবই স্বাভাবিক মনে হতো আমাদের। স্বাভাবিক মনে হবেই না বা কেন? আমাদের মায়েরাই তো এসব অন্যায় আচরণ চুপ করে সহ্য করে গেছেন। তাদের চুপ করে থাকার এই শিক্ষাও তো পরিবার পরিক্রমায় পাওয়া। এজন্য আমাদের মা-বাবা আমাদের যতই পড়াশোনা করে মানুষ করুন না কেন, দিনশেষে একটা কথাই মন এবং মস্তিষ্কে তারা ভালোভাবে গেঁড়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন, যদি তুমি ছেলে হও তাহলে তোমার স্ত্রীর সাথে যেমন খুশি তেমন আচরণ করতে পারবে। আর যদি তুমি মেয়ে হও তাহলে তোমাকে সবার মন যুগিয়ে চলতে হবে, তা যতই অন্যায় আচরণ করা হোক না কেন। ফলাফল হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি এই পরিক্রমা অনুসরণ করে বছরের পর বছর এক অসুস্থ সমাজ গড়ে উঠছে, যে সমাজ থেকে আপনি আমি কেউই বাদ নেই। ব্যতিক্রমধর্মী পরিবার অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু ব্যতিক্রমকে উদাহরণ হিসেবে টানতে গেলে সামাজিক অনেক বড় একটি সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া হবে।

‘‘অনেকদিনের সম্পর্ক, একটু অ্যাডজাস্ট করে নিলেই হয়ে যাবে” অথবা “বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে সেহেতু স্বামীর মন যুগিয়ে চলতে হবে”- শিক্ষিত হোক কিংবা অশিক্ষিত, এসব বদ্ধমূল ধারণা থেকে আমাদের মেয়েরা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পরিবারের একরোখা সিস্টেমের কারণে বেরিয়ে আসতে পারে নি। অ্যাডজাস্টমেন্ট কিংবা মন যুগিয়ে চলা মানে এই নয়, যে আপনার সাথে হওয়া সকল অন্যায় আচরণ আপনি মাথা পেতে নেবেন। মনে রাখতে হবে, নিজের সম্মান নিজেকেই দিতে হয়, অন্যথায় কেউ আপনাকে সম্মান দিতে আসবে না। আপনি শিক্ষিত হোন কিংবা অশিক্ষিত, নিজের আত্মসম্মানের সাথে কোনোভাবেই কম্প্রোমাইজ করা উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, এক পাক্ষিকভাবে কোনো সম্পর্ক টেকে না। টিকলেও পরবর্তীতে তার ভোগান্তি নরকযন্ত্রণা থেকেও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। সম্পর্ক হতে হবে পারস্পরিক কিংবা রেসিপ্রোকাল (Reciprocal)। যেখানে পরস্পরের যৌক্তিক চাওয়া-পাওয়া থাকবে, একে অন্যকে সম্মান দিতে জানবে। যেখানে আত্মমর্যাদা সবার উপরে প্রাধান্য পাবে।

এজন্য ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি তাদের পুরুষ এবং নারী কন্সেপ্ট থেকে বের করে এনে তাদের যথাযথ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন। তাদের আত্মমর্যাদাবান হিসেবে গড়ে তুলুন। ছেলে হোক কিংবা মেয়ে, কেউ যাতে কাউকে অন্যায় আচরণ দিয়ে হেনস্থা না করে সেই শিক্ষা দিন একদম ছোট বয়স থেকেই। দীর্ঘদিনের একরোখা সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে, পরবর্তী প্রজন্মকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সুন্দর সমাজ উপহার দিতে চাইলে এর কোনো বিকল্প নেই।

কারণ অন্যায় আচরণের সাথে আজকের অ্যাডজাস্টমেন্ট, আপনার আগামী দিনের শান্তি নষ্ট হওয়ার কারণ। এজন্য, সাবধান! নিজের আত্মমর্যাদার সাথে কখনই কোনো কম্প্রোমাইজ নয়।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]