November 2, 2024
মুক্তমত

বিয়ে বনাম আধুনিক দাসী ও মাতৃচক্র

মৈত্রেয়ী মিথিলা।। বিয়ে যেকোনো মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় হার, অন্তত আপাতদৃষ্টিতে তাই!

আপনার মাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। কলেজ লাইফে বেচারিরও হয়তো এমন কোনো স্বপ্ন ছিল, যেটা স্বামীর চাকরিতে উন্নতি কিংবা বাচ্চাদের ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার চেয়েও বেশি সুন্দর ছিল! হয়তো চাকরির পাশাপাশি শখের একটা গানের স্কুল কিংবা বিউটি পার্লার কিংবা ফ্যাশন হাউজ করার ছিল! কিন্তু বিয়ের পর কয়জন মেয়ে এরম ছোট ছোট কোয়ালিটির জন্য প্রশংসা পায়? উৎসাহ পায়?

আমার মা স্কুল লাইফ থেকে যেকোনো ধরণের সেলাই চোখ বুজে করতে পারে! আমার জামা কখনোই টেইলারকে দিয়ে বানাতে হয়নি! পরিচিত কারো বিয়েতে বৌ সাজানোর জন্য পার্লার থেকে বিউটিশিয়ান না আনিয়ে আমার মাকে ডেকে নিয়ে যেতো। এমন হাজারো গুণ আপনার-আমার মায়েদের আছে, যেগুলো শ্বশুরবাড়ি এসেই বাচ্চা পয়দা করা আর ঘরের কামলা খাটায় হারিয়ে গেছে।

আপনার মা দেখেছে, ওনার মা তাকে শিখিয়েছে যে তার জীবনে সব পড়াশোনা, সেলাই আর গান শেখা সবকিছুই ভালো বিয়ে হওয়ার জন্য! তার নিজের জীবনের জন্য না, তার কোনো স্বপ্ন পূরণের জন্য না, খালি সমাজের চোখে একটা ভালো বিয়ের জন্য! বিয়ে হয়ে গেলে ওসব আর লাগেনা! তখন রান্না আর ঘরের কামলা খাটাই সব, ভালো কামলা হতে পারলেই গালি খাওয়া থেকে বাঁচা যায়। বাচ্চা হলে পরে বাচ্চা বড় করা তার দায়িত্ব, চাকরি করলে তো বাচ্চা সামলানো, ঘরের-বাইরের কাজ, চাকরি, সব করে একপ্রকার ওয়ান্ডার উওম্যান হলেও বরের কথার উপর কথা বললে বেলাজ-বেশরম-মুখরা মাইয়া! নিজের পতিব্রত রক্ষা তার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ, এইটা গেলেই সব গেছে!

ওই থেকে দেখে-ঠেকে শিখে আপনার মাও আপনাকে সতী বানাতে লেগে গেলো। আপনাকেও ওড়না পরিয়ে রাখা, ছেলেদের সাথে কথা না বলা, প্রেম মহাপাপ এসব শেখানো আর ধার্মিক বানানোর কাজে লেগে গেলো। সাথে আপনাকে পড়াশোনা শিখিয়ে, গান-নাচ-আঁকা শিখিয়ে আধুনিক পাত্রী বানানোর প্রজেক্টেও নিজের সর্বোচ্চ দিলো। মানে আমরা কিংবা আমাদের মায়েরা আর তাদের মায়েরাও, বিয়েকেই মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ভাবতে বাধ্য, আমাদের বাধ্য করা হয়েছে।

আপনাকে ধার্মিক হতেই হবে! প্রেম কেন করা যায়না কিংবা বিয়ে না করলে কার কী ক্ষতি হবে জিজ্ঞেস করলেই সমাজ বলবে আপনি অলক্ষুণে, বখে যাওয়া নষ্ট মেয়ে। আমাদের মেয়েদের জীবনের লক্ষ্য সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতিতে অবদান রাখা না, আমাদের মেয়েদের জীবনের লক্ষ্য সুগৃহিনী, সতী, পতিব্রতা নারী হওয়া! সুগৃহিনী, সতীনারী, দেবী নামের দাসী হওয়ার পরেও যদি কেউ রাজনীতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান নিয়েও কাজ করতে পারে তো তারা পথিকৃত হয়, কিন্তু এতো অপরিসীম সাহস, ধৈর্য্য, সহ্যক্ষমতা নিয়ে কয়টা মানুষই বা পৃথিবীতে আসে! তাই আমাদের মতো মেয়েরা দিনশেষে আধুনিক পাত্রীই হয়ে ওঠে বড়জোর!

আপনার সমস্ত ইচ্ছা, স্বপ্ন, আশা সবকিছুতে বাঁধার প্রথম এবং প্রধান কারণ আপনার মা বাবার ভয় যে আপনি সমাজের চোখে অসতী, কুলটা, রীতিবহির্ভূতা না হয়ে যান! আর তারপর আপনার ভালো বিয়ে যদি না হয়! আর এভাবে হাজারো স্বাধীনচেতা, স্বপ্নদেখা মেয়েরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শেকলে বাধা পড়ে নিজেদের স্বপ্ন বলি দিয়ে নিজেদের মেয়েদেরও ধার্মিক, সতী, সুগৃহিনী বানানোর নোংরা খেলা খেলতে থাকেন।

আমরা সবাইতো এখনো বেরোতে পারলাম না, কিন্তু পুরোটা বুঝতে তো পারি! তবু কেন ভাঙতে পারিনা এই দুষ্টচক্র?

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]