সরিষা দানার জীবন
শাওন মাহমুদ।। সময়টা অদ্ভুত। শুধু দৌঁড়ে সামনে এগোয়, তাল মিলাতে হিমশিম খাই আমরা সবাই। নিজেকে চিনে নেয়ার মতন সময় হাতে পাই কম। নিজের সাধ্য, সংকুলতা বা প্রসারতা পরিমাপ করবার মতন সময় একেবারে নেই তো! তাই অন্যের সফলতা, ভালো কাজে, আমরা মন বেজার করি, যা হয়তো নিজেকে জানা থাকলে মন খারাপের ছিঁটেফোটাও মনে আসতো না। নিজ সাধ্য জানা থাকলে তো আরো নয়।
নিজেকে যখন একেবারেই চিনতাম না, নিজের সাধ্য একদমই জানা ছিল না, স্কুলের কোন বন্ধু যখন নাসা বা ইউএন-এ কাজ করছে বলে জানতে পারতাম, তখন খুব মন খারাপ হতো। শুধু মনে হতো আমারও তো অনেক ভালো রেজাল্ট ছিল, মাথা ভালো ছিল, মেধাবী ছিলাম। আমি কেন ঘরকন্যা হয়েই রয়ে গেলাম। জানা ছিল না আমার নিজস্ব ব্যর্থতা আর সময়ের অপচয়ের পরিমান। জীবনের সফলতা কোথায় লুকিয়ে আছে, একদমই জানা ছিল না।
বয়স বাড়বার সাথে সাথে আশেপাশে থাকা মানুষের প্রশ্নে জর্জরিত হতাম। কী করেন? কোথায় আছেন? কেন কিছু করেন না? ইত্যাদি আরো কত প্রশ্ন। অথচ তারা কখনও আমার সমস্যা নিয়ে কথা বলতে চাইতেন না। আমার অপারগতা কোথায়, জানতে চাইতেন না। আমার ইচ্ছেগুলো, কখনও জানতে চাইতেন না। কঠিন সময়ে পাশে এসে কখনও বলতেন না, তোমার সাথে আছি। ক্রমশ নিজের অবস্থান জানার জন্য নিজেকে সময় দেয়া শুরু করলাম। জীবন সুন্দর, বাঁচতে হবে সবার মাঝে, প্রশ্নের উত্তর নিজেকে বের করতে হবে। তথাকথিত সফলতার অর্থ পাল্টিয়ে বের করে নিতে হবে নিজের পরিচয়। ঠিক তারপর থেকেই ফেলে আসা বছরগুলোর পোস্টমর্টেম করা শুরু করলাম।
ঝঞ্ঝা আর দুর্বিপাকময় জীবন ছিল আমার। একটু সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই প্রচন্ড আঘাতে কাত হয়ে পরতাম। একা লড়াই করতে হতো। সোজা হতেই সময় গড়িয়ে যেতো অনেক। ঝড়ের বেগে চলে যাওয়া সময়ে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ কমে গিয়েছিল একদমই। আত্মীয়স্বজন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। সংসার সন্তান সামলিয়ে যখন ঝরঝরে হলাম, তখন দেখি বয়স বেড়ে চল্লিশের কোঠায়৷ টেনেটুনে গ্রাজুয়েশন করেছিলাম, তারপর পড়ার পাট গুটানো হয়ে গিয়েছিল জীবনের ভারে। অঢেল সময় পেলাম, তবে তা তরুণ বয়সের মতন কাজে লাগানার নয় কখনোই। আশেপাশে বন্ধুদের খুঁজে পেতে বেগ পেতে হচ্ছিল। সময় যা যাবার চলে গেছে, অনেক। বয়স অনুযায়ী সাধ্য জানা হয়ে গিয়েছিল ততদিনে।
জীবন সঙ্গী তখন মা আর টিপু। মা’র সারাজীবনের একা লড়াই করা ক্লান্ত অবয়বকে আর বিভ্রান্ত করতে চাইনি। আমাকে দিয়ে কিছুই হয়নি, হবে না, সারাজীবন শুনতে শুনতে মাথায় গেঁথে গিয়েছিল একদম। বারবার কথাগুলো বলবার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল আমার। একটা সময় ঘন্টার পর ঘন্টা টিপু এই নিয়ে কথা বলেছে আমার সাথে। দিন শেষে তার নির্দিষ্ট কিছু বাক্যই ঘুরপাক খেতো সে সময়গুলোতে। নিজেকে ভালোবাসতে শেখো আগে। সময় বলে দেবে তোমার সফলতার গল্প। কারো জন্য বসে থাকবে না। নিজে যা জানো সেসব কাজ নিজে করতে শেখো। পৃথিবীতে কেউ কারো নয়।
এরপর থেকেই খুব ধীরে, ছাদবাগানে গাছের সাথে সখ্য গড়ে তুললাম। ঘরকন্যা আমি ক্রমে চাষী হয়ে উঠলাম। গত দশ বারো বছরে নতুন পরিচয় দিলাম নিজেকে।
সরিষা দানা ছিটিয়ে দিতেই কয়েকদিনে ডালপালা বের হয়, ফুল আসে, একটা সময় সরিষা ধরে তাতে, সরিষা তেল হয়। এই সরিষা দানা আমার সাধ্য চিনিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল প্রচন্ডভাবে। ভাবতে শিখেছিলাম, একটা সরিষা দানারও পরিচয় আছে, বিস্তৃত হওয়ার ক্ষমতা আছে, প্রসারিত হয়ে ফুল ফল ফলাবার সাধ্য আছে, মানুষের কাছে পৌঁছানোর মাঝেই নিশ্চয় তার সফলতা নির্ধারিত। তাহলে একজন মানুষ আমি, আমারও নিজের পরিচয় আছে, যে কাজই করছি না কেন, তার মাঝে সফলতা আছে। আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না- বলা বন্ধ করে দিলাম তখন থেকেই।
নগরচাষী শাওন মাহমুদ, সরিষা দানার মতন বিস্তৃত হয়ে নিজের দুটো হাত দিয়ে চাষাবাদ করে, সবুজ ভালোবাসায় সমৃদ্ধ করে তোলে চারপাশ। যতটুকু সাধ্য ঠিক ততটুকুই। এরচেয়ে বেশি চাইবার বা করবার মতন সময় পার করে এসেছে অনেক আগে। যার যার জীবন যে সময়ে এসে বাহিত হয়, তার তার কাজ আর সফলতাও সেই সময়ে নির্ধারিত। তথাকথিত সফলতার সংজ্ঞাকে নিজ ছায়ার পাশে রেখে, সবার সাথে তাল মিলিয়ে এখন আমি মন খুলে বলতে পারি, এই যে শুনছেন! জীবন সুন্দর, নিজ সাধ্য মতন উপভোগ করুন।