November 22, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

নিঃসঙ্গ শেরপা

জায়েদ বিন আলী সুজন।। বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার কয়েকটি পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলো। সে সময় তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে  বলেছিলেন- ‘মুজিব ভাই, আপনি আপনার শত্রুদের সমালোচনার পথ বন্ধ করে দিলেন। ঠিক হয়নি। এখন আপনার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদের ভাষা হবে একটিই- গুলি। আপনার সাথে সাথে যে গুলির একটি আমার জন্যও হয়তো বরাদ্দ আছে। এর পরিনাম, এ দেশ পিছিয়ে যাবে আরো অনেকগুলো বছর।’

এই সেই তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের আগে ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকগুলোর সময়ে ভুট্টো যাকে ‘বড় সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, আখ্যায়িত করেছিলেন ‘Notorious’  বলে। উত্তেজিত কণ্ঠে ইয়াহিয়াকে বলেছিলেন, ‘This Tajuddin, I tell you, will be your main problem’।

কতটুকু জানি আমরা তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে? যা জানি তাই কি যথেষ্ট?

মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর যে নামটি অনিবার্যভাবে এসে যায় তিনি বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশের চব্বিশ বছরের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতার যুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার পথেও জাতির পিতার ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছেন তাজউদ্দীন আহমদ।

স্কুলজীবন থেকেই তাজউদ্দীন ছিলেন রাজনীতি-সচেতন। শান্ত, সংযমী, মিতভাষী, দায়িত্বশীল ও স্নেহপরায়ণ এক অনন্য গুণাবলিসম্পন্ন হিসেবে শৈশব-কৈশোরে বেড়ে ওঠেন তিনি। কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ প্রাইমারি স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মফিজউদ্দীন সাহেব তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালে তাজউদ্দীন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী ক’রে সব শিক্ষকের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘সে হলো গ্রেট স্কলার। সে হলো রত্ন।তার মাঝে আমি বিরাট ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি।’

প্রধান শিক্ষক মফিজউদ্দীন সাহেবের সেই ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হয়নি।

১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বাংলা প্রদেশের একমাত্র বোর্ড কলিকাতা বোর্ডে তিনি ১২তম স্থান অর্জন করেন। ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায়ও তিনি ঢাকা বোর্ড থেকে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাজউদ্দীন আহমদ অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন।

জানা গেছে, মাত্র ২৮ বছর বয়সে তাজউদ্দীন আহমদ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে তার কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান তাকে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছয় দফা আন্দোলনে তাজউদ্দীন ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেন শেখ মুজিবকে। শেখ মুজিব যেদিন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হন, সেদিনই তাজউদ্দীন হন সাধারণ সম্পাদক।

একাত্তরের ১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বেই গঠিত হয় স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকার। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতিত্বের নিদর্শনস্বরূপ তাজউদ্দীন এই সরকারের নামকরণ করেছিলেন ‘মুজিবনগর সরকার’।

স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনালগ্ন থেকে একেবারে অন্তিম পর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গতাজ ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদ তীব্রভাবে বঙ্গবন্ধুর অভাববোধ করতেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ এবং সামনে রেখে দৃপ্ত প্রত্যয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাজউদ্দীন আহমদ বড় আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ আমি যদি মন্ত্রিসভায় থাকতাম তাহলে কেউ বঙ্গবন্ধুর গায়ের লোম পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারত না। তিনি আরও বলেছিলেন, মুজিব ভাই জেনে যেতে পারলেন না কারা তার বন্ধু ছিল আর কারা তার শত্রু ছিল।’

সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাত্র দুই মাস ১৮ দিনের মাথায় সংঘটিত হয় বাঙালির ইতিহাসের আরেক নির্মমতার করুণ কাহিনী- ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ড। কারাগারে বন্দি অবস্থায় নির্মমভাবে শহীদ হন তাজউদ্দীন আহমদ। বুকের রক্ত দিয়ে বঙ্গতাজ প্রমাণ করে যান যে, কোনও প্রলোভনেই তিনি জাতির পিতার সঙ্গে বেইমানি করেননি।

আজ এই কীর্তিমান মহান নেতার ৯৫তম জন্মবার্ষিকী। যুগন্ধর এই রাজনীতির সাহিত্য-স্রষ্টা বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ ভালো থাকুন আপনি।