আমার শরীর আমার সিদ্ধান্ত
শারমিন শামস্।। পশ্চিমে বাক্যটা হল- My body my choice. নারীবাদী স্লোগান হিসেবে বিখ্যাত; মূলত গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন তারই ফলশ্রুতিতে এই স্লোগানের জন্ম, এরপর সেটি আর শুধু গর্ভপাতে আটকে থাকেনি, বিস্তৃত হয়েছে সন্তান ধারণের ইচ্ছা অনিচ্ছায়, পোশাক পরা না পরার স্বাধীনতায়, যৌনতার ইচ্ছায় ও ধরণের অধিকারে। শরীরের পছন্দ, ইচ্ছা অনিচ্ছার চিন্তাটি পশ্চিমেও আটকে থাকেনি, প্রসারিত হয়েছে পূবে দক্ষিনে উত্তরে, এশিয়া আফ্রিকার দেশে দেশে।
নারীবাদ আন্দোলন নারীর শরীরের স্বাধীনতার কথা বললেই একদল নারী পুরুষ ছ্যা ছ্যা করে ওঠেন। তাদের চিন্তার জগতে শরীরের স্বাধীনতা মানেই যৌনতার স্বাধীনতা। নারীবাদ নিয়ে এক শ্রেণির মানুষের কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা আর গোঁড়ামিকে পুঁজি করে নারীবাদের মুখটি চেপে ধরার উদ্দেশ্যেই তারা এই চিন্তাজগৎটিকে ধারণ করে, লালন পালন করে এবং প্রসার ঘটাতে চায়।
আমার শরীর আমার পছন্দ- এই কথাটির মানে শুধু যৌনতায় আবদ্ধ নয়। কিন্তু এটিও সত্য যৌনতা এখানে অনেকটা অংশ জুড়ে আছে এবং সেটি কোন অন্যায় নয়। যৌনতা মানবজীবনের অতি স্বাভাবিক সুস্থ একটি প্রক্রিয়া এবং সেটি নারী, পুরুষসহ সব লিঙ্গের জন্য প্রযোজ্য। যৌনতায় পুরুষের আগ্রহ, ইচ্ছে, পছন্দ যেমন সত্য ও স্বাভাবিক; ঠিক তেমনি নারীর যৌনতাও। কিন্তু যুগে যুগে নারীকে অবদমনের জন্য তার যৌনতার ইচ্ছেকেও নিয়ন্ত্রণ ও শোষন করা হয়েছে। দিনের পর দিন নারীর উপর যৌন আধিপত্য বিস্তার করে গেছে পুরুষ, পিতৃতন্ত্র তাকে সেই ক্ষমতা ও সুযোগ দিয়ে রেখেছে। নারী আইনী ও বেআইনী- দুইভাবেই হয়েছে ধর্ষণের শিকার। আবার একই সাথে নারীর যৌনতার আনন্দকে অস্বীকার করেছে পুরুষ, তাকে বঞ্চিত করেছে চরম পুলক থেকে। নারীর যৌনতার ইচ্ছেকে বলা হয়েছে অভিশপ্ত, কেটে দেয়া হয়েছে ভগাঙ্কুর, নিষ্ঠুর নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে তার স্বাভাবিক শরীরিক চাহিদাকে।
পুরুষ নারীকে চেয়েছে যৌনদাসী হিসেবে। পুরুষের সব ধরণের আরাম আয়েশের স্বার্থে নারীকে ব্যবহার করেছে। নারী হয়েছে বংশবিস্তারের যন্ত্র। এজন্য নারীর মতামতের তোয়াক্কা করা হয়নি। নারীর শারীরিক সক্ষমতা ও সুস্থতাকে আমলে নেয়া হয়নি। নারীর মানসিক অবস্থাকে পরোয়া করা হয়নি।
নারী পুরুষের যৌনসম্পর্কে পুরুষ থেকেছে ঝাড়া হাত পা। ভিকটিম হয়েছে নারী। এবং এখনও হচ্ছে। গর্ভধারণের অপরাধ, যন্ত্রণা এবং সামাজিক অবমাননাকে মাথা পেতে নিয়েছে নারী। আবার গর্ভপাতের অধিকারের জন্য তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ লড়াইয়ের রক্তাত্ত পথ।
পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞান প্রযুক্তির উৎকর্ষে ঝা চকচকে হয়ে উঠছে মানব সভ্যতা। তবু আজো এই দেশে ষোলো বছরের কিশোরী মাতৃত্বের বোঝা নিয়ে আমাদের মুখোমুখি। এই দায় কার? সন্তান ধারণ এখনও নারীর সিদ্ধান্ত নয়। সিদ্ধান্ত নেয় পুরুষ, এই সমাজ। শিক্ষিত কর্মজীবী মেয়েদের সন্তানের জন্য মানসিক চাপে রাখা হয়, অপমান আর গঞ্জনার ভেতর দিয়ে যেতে হয় তাদের। এই দায় কার?
এই সমাজ নারীর পোশাক নির্ধারণ করে। নারীর পছন্দ ও আরামকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই সমাজ নারীর চিন্তা রুচি ও স্বাধীনতাকে ধর্ম আর মূল্যবোধের নামে শোষণ করে।
My body my choice- কথাটিকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে ‘আমার শরীর আমার সিদ্ধান্ত’ করে নিয়েছি। কারণ সিদ্ধান্তটিই শেষ কথা এবং মূল কথা। পছন্দকে সিদ্ধান্তে রূপ দিতে পারাটা জরুরি।
ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর লেখা আহ্বান করেছিল ‘আমার শরীর আমার সিদ্ধান্ত’- এই বিষয়ে। প্রচুর লেখা চলে এসেছে। প্রায় সব লেখাই প্রকাশ হবে। লেখকদের প্রতি শুভকামনা রইলো। সাহসী লেখক ও চিন্তাশীল পাঠকই সুস্থ আলোকিত সমাজ তৈরি করবে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
ভালবাসা সবাইকে।