ফ্রেন্ডলিস্টের ফ্রেন্ড কোরবানিতে ত্যাগের মহিমা
মাসকাওয়াথ আহসান।। করোনাকালে অনেকে পশু কোরবানি দিতে না পেরে মনমরা। শুধু বনের পশু কোরবানি না দিয়ে মনের পশু কোরবানি দেবার কথা বছর বছর বলেও কোন লাভ হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থৈ থৈ করছে মনের ও বনের পশুতে।
সুতরাং কোরবানির সব ব্যবস্থা আপনার হাতের কাছেই আছে। কিন্তু কী করে বুঝবেন; কাকে কোরবানি দেয়া উচিত; কাকে উচিত নয়। মানুষ মানেই তার মধ্যে কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মাৎসর্য থাকবেই। কিন্তু করোনাকালে মানুষ সুযোগ পেয়েছিলো ষড়রিপুর তাড়না আর সেভেন ডেডলি সিনস থেকে মুক্ত হবার। সে সুযোগ যারা নিতে পারেনি; তাদের সংস্কারের সম্ভাবনা আর আছে কী!
ব্যাক্তিগত জীবন আর কর্মক্ষেত্রে সতত নানা ট্র্যাশ আপনাকে নিতে হয়। যতই গান গেয়ে উঠুন, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও; তিক্ততা এসে হানা দেবেই। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরতে এসে আর তিক্ততা প্রতিপালনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
ছোট বেলায় যারা ‘‘পাছে লোকে কিছু বলে’’ কবিতাটা পড়েছিলেন; তা শুধু পরীক্ষায় পাশ করার জন্যই পড়েছিলেন। ঐ কবিতাটা বুঝে পড়লে আজ আর ঘটা করে এই আনফ্রেন্ড করার উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি গাইড বুক লেখার দরকার হতো না।
মানুষকে পাত্তা দিয়ে মাথায় তুলেছেন আপনি; সমস্ত ভালোর দায়িত্ব পড়েছে আপনার কাঁধে। আপনার টাইম লাইন হয়েছে ‘মনের পশুদের’ গোস্বা নিবারণী পার্ক। আপনি যেন রাগী আংকেল-আন্টির পাঞ্চিং ব্যাগে পরিণত হয়েছে। এইটা কেন হয়েছে; বলেন তো ভাই, আপনি কি কারো খান নাকি পরেন! নিজের তিন বেলার খাবার নিজে যোগাড় করেন আপনি; আর ফেসবুকে গোস্বা মামারা এসে নিজের দুই ইঞ্চি চিন্তার গজফিতা নিয়ে আপনাকে মাপামাপি করে; আপনি এটা সহ্য করেন; কারণ আপনি সবার কাছে ভালো হতে চান; সব গণতন্ত্র চর্চার দায় পড়েছে যেন আপনার। এই সর্বদা আইসক্রিম বিক্রেতা হবার ইচ্ছাটা ক্ষতিকর।
স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামাতের লোক আপনার কাছে এসে গণতন্ত্র চাইলে আপনি তাকে তা দেবেন কেন! এই লোকগুলো আপনাকে চেতনা-জাতীয়তাবাদ-ঈমান কতো কিছু সহি করতে বলে; অথচ এরা টাকাচুরি ও পাচার করে দেশটা ঝাঁঝরা করে দিলো; সেদিকে তাদের নজর নেই; অনুতাপ নেই; বিচলন নেই। শতছিদ্রের ঝাঁঝর এসে সুঁচের একটি ছিদ্র নিয়ে যখন আলাপ শুরু করে, তখনই আপনি বিসমিল্লাহ করতে পারেন ফ্রেন্ড কোরবানির। এমন ঘরের বন্ধু বিভীষণ আপনার দরকার কী!
যারা নিজের নাকটাকে নিজের কাছে রাখতে পারে না; আপনার চিন্তায় ও কাজে নাক গলায়; সেই লম্বা নাকটি কোরবানি দিয়ে দিন।
দুই রকম লোক আছে। গত পয়লা বৈশাখে যারা পান্তা-ইলিশের বিপক্ষে লেগেছিলো; কিংবা পয়লা বৈশাখকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলেছিলো; ওটা হচ্ছে শিবিরের ডিসকোর্স। এদের ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে কোরবানি দেয়া ফরজ। আমি পয়লা বৈশাখে কী খাবো; কী পরবো; সেইটা আমার ব্যাপার! চামচিকারে কে বানাইলো মাতব্বর; যে সে এসে আমার ব্যক্তিগত পছন্দে বাগড়া দেবে।
আরেকরকম লোক আছে; যারা কোরবানি ঈদ এলেই পশুক্লেশ নিবারণী সংস্থা হয়ে প্রাণ ও প্রাণির ভালোবাসায় গৌতম বুদ্ধ হয়ে পড়ে; কোরবানি দেবেন না বলে আর্তনাদ করে; ওটা হচ্ছে শিবসেনার ডিসকোর্স। এদের ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে কোরবানি দেয়া অবশ্য প্রয়োজন। যে কারণে শিবিরকে আনফ্রেন্ড করেন; সেই একই কারণে শিবসেনাকে আনফ্রেন্ড করতে হবে। সেটাই ন্যায়বিচার।
কট্টর চিন্তার রাগী লোক ফ্রেন্ডলিস্টে দিনের পর দিন পুষলে আপনি কট্টর ও রাগী হয়ে যাবেন। বদ্ধ চিন্তার লোকের সঙ্গে দিনের পর দিন মিশলে আপনার চিন্তা বদ্ধ হয়ে যাবে। ডাম্বের সঙ্গে থাকতে থাকতে ডাম্ব হয়ে যাবার ব্যাপারটা পরীক্ষিত সত্য।
ফেসবুকে আপনি এসেছেন পৃথিবীর একমাত্র সাম্যবাদী স্পেসের আনন্দ নিতে। এইখানে আপনার কোন প্রয়োজন নেই কারো জমিদারি এটিচ্যুড দেখার। যারা পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সম্মান-ভালোবাসার ভিত্তিতে মিশতে অক্ষম; তাদের ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে কোরবানি না দেয়া মানে; আপনি বিকাশমান সাম্যচিন্তার পৃথিবী গড়তে ভূমিকা রাখছেন না।
কলেজ জীবন শেষ করার আগেই; বিশ্বের গালি-অভিধানের ওপর দখল আনা জরুরি; কারণ পৃথিবীর যেখানেই যান; আপনি তাদের ভাষা জানেন না বলে কেউ গালি দিলে খপ করে ধরতে পারবেন। এই গালি ব্যাপারটা জানতে হয়; বন্ধুদের সান্নিধ্যে প্রাইভেট স্পেসে চর্চা করতে হয়; কিন্তু পাবলিক স্পেসে গালাগাল একটি ফৌজদারি অপরাধ। ফেসবুক হোমপেজে গিয়ে যেসব লোককে দেখবেন বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণী মানুষ কিংবা হাইব্রিড অপরাধীর অথবা নেহাত নারীর ছবি বা স্ক্রিনশট করে; গালির মজমা বসিয়েছে; তাকে আজই কোরবানি দিয়ে দিন; তার পোস্টে মন্তব্যকারী গালিবিদ কমন ফ্রেন্ড থাকলে তাকেও ঝেড়ে দিন। কোটি কোটি মানুষের পৃথিবীতে হাত বাড়ালেই বন্ধু; তাই গালিগোরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো এটা মনে রেখে, ‘‘সে নো টু স্ল্যাংস’’; দেখবেন বন্ধুর অভাব হবে না।
কিছু লোক আছে, আপনার পোস্টে এসে মন্তব্য করবে না; কিন্তু আপনি যে বিষয়ে পোস্ট দিয়েছেন; তা নিয়ে ঠারে-ঠুরে বাঁকা কথা দিয়ে পোস্ট দেবে; এরকম পিপিং টম কোরবানি দিয়ে দেন আজ। কারণ এ হচ্ছে স্টকার; অন্যের সঙ্গে তুলনামূলক জীবনযাপন করে; এ ক্রমশ ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়বে; তাই এরকম বন্ধুক্লেশ মুক্ত হওয়া নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
যারা প্রকৃত সেলিব্রেটি ও গুণি লোক; তারা কিন্তু সাদাসিধে মানুষ হয়; কোন সেলিব্রেটির মাঝে এটিচ্যুড থাকলে বুঝতে হবে; এর খ্যাতি পনেরো মিনিটের; কিছুদিন পরেই ফ্লপ মারবে। কাজেই এটিচ্যুড-ওয়ালা সেলিব্রেটিকে কোরবানি দিন। সেলিব্রেটির পেইজ ফলো করতে পারেন; তাকে ফ্রেন্ডলিস্টে রাখার মানে হয় না। সে তো কোনদিন ঘুরেও আপনার পোস্ট পড়বে না। কাজেই ফ্রেন্ডলিস্টকে এরকম দাম্ভিক তালগাছমুক্ত করুন। জমিদারি প্রথার বিলোপ হয়েছে সেই শেরে বাংলার কালে; আজকের বুবু বাংলায় আর কোন ভি আই পি কালচারকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক নয়। কোরবানি দিন ফেসবুকের ভি আই পি ফ্রেন্ড।
আপনার সাহসী পোস্টে যে ‘‘সাতে পাঁচে থাকিনা দাদা’’ এসে মন্তব্য করে, ‘‘৫৭ ধারায় ধইরা লইয়া যাইবো কইলাম’’; এরকম কাপুরুষ ফ্রেন্ড আসলে দুধভাত মানুষ। ভয়ে ভয়ে বাঁচে এরা। এদেরকে আজই বলে দিন, সংকোচেরই বিহ্বলতা নিজেরে অপমান; এক বছর সময় দিন। যদি ‘‘সাতে পাঁচে থাকিনা দাদা’’ এমন অ্যামিবা জীবন থেকে বেরিয়ে সাহসী হতে না পারে; সামনের বছর কোরবানি ঈদে তাকে বিসমিল্লাহ করে দিন।
আরেক রকম ফ্রেন্ড আছে, যারা এসে আবদার করবে, অমুক আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে কেন; সে তো তমুক। যেন সে নিজে পৃথিবীর বিশুদ্ধতম মানুষ। মানসিকভাবে কিন্ডারগার্টেনে রয়ে যাওয়া এইসব বুড়ো শিশু, কোরবানি দিয়ে দেন।
আরেকরকম লোক আছে, নিজে দলীয় চাঁদা ও অনুদানে চলে; ফলে নৈর্ব্যক্তিকতা ও নিরপেক্ষতার মানে বোঝে না। এরা হচ্ছে কোন একটা পক্ষের মাজারের খাদেম। ঈশ্বর বা যে কোন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাকে দেখবেন ভালোই লাগে; কিন্তু সহ্য করা যায় না তাদের ফ্যানক্লাব। ভাত খেতে পছন্দ করেন বলে; ফ্যান খেতে হবে এমন কোন কথা নেই। আজই ধর্মীয় ও দলীয় খাদেমদের কোরবানি দিয়ে সতত নৈর্ব্যক্তিকতা চর্চা করুন। যদি পক্ষ নিতে হয়; পক্ষ নিন মানবতার; যে কোন ধর্ম-গোত্র-দলের ফ্যাসিজমকে কোরবানি দিন।
উল্লেখ্য যে ফেসবুকের এই ফ্রেন্ড কোরবানিতে বন্ধুটি পুনর্ভাবনার সুযোগ পান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের ভুল বুঝে ফিরে আসেন তারা। এরপর তিনি আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে উঠতে পারেন। এটা প্রেমেরও ফর্মূলা। তবে সে বিষয়ে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে লেখা ঠিক হবে না। কারণ এসব হচ্ছে মেল চ্যাপ্টারের আলাপ।
ফ্রেন্ডলিস্টের বন্ধু কোরবানি কোন ক্ষতিকর বিষয় নয়; এটা নেহাত একজন মানুষকে সংশোধনের সুযোগ দেয়া। আর একটা কথা মনে রাখা আবশ্যক; আপনার যদি মনের ডাক্তারের সার্টিফিকেট না থাকে; তাহলে হোমিওপ্যাথির মনের রোমিও হয়ে কারো কাউন্সেলিং-এর চেষ্টা করা বৃথা। ফেসবুকে আপনি আনন্দে সময় কাটাতে আসেন; কারো ট্র্যাশ নেয়ার দরকার কী! ট্র্যাশ তো আপনাকে প্রেমের ক্ষেত্রে প্রতিদিনই নিতে হয়; তাই বন্ধুত্বে ট্র্যাশ নিলে নিজেকে একসময় মি/মিস ট্র্যাশ বিন মনে হবে কিন্তু।
আনফ্রেন্ড ও ব্লক করার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিকে বলুন, বড়’র প্রেম শুধু কাছেই টানেনা; দূরেও ঠেলিয়া দেয়।